বাঁশ বৈভব: জলজঙ্গল ও মানুষ পেরিয়ে

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১০:৫৯

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১০:৫৯

ছবি সমসাময়িক
শাহীন দিল-রিয়াজের সাম্প্রতিক সিনেমা 'বাঁশ বৈভব' লাখো বাঁশ একসঙ্গে বেঁধে উৎস থেকে ভাসিয়ে বন্দর ও বাজারে নিয়ে আসার যাত্রার চলচ্চিত্রায়ণ করে এক মহাকাব্যিক ঢঙে। এতে আছে জল ও জঙ্গল, আছে মানুষের গল্প। কিন্তু এসব ছাড়িয়ে 'বাঁশ বৈভব' এক অনন্ত যাত্রাকে চলচ্চিত্রায়িত করে, যা অবলোকন করে আমাদের চৈতন্য সংক্রমিত হয় মহাকালের প্রশান্ত অভিঘাতে। প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে চৈতন্যের দেখাকে ও ভেতরের বোধকে প্রকাশ করে সিনেমা। এ মাধ্যমটির রয়েছে তাৎক্ষণিকতা, অর্থাৎ যখন সিনেমাটি দেখছি তখন পর্দার দৃশ্য শরীরকে সরাসরি উদ্দীপ্ত করে, যে কারণে অ্যাকশন ও যৌনতা থাকে বক্স অফিস হিট করা সিনেমার পরতে পরতে। কিন্তু সিনেমার প্রধান শক্তি হলো, একটি সিনেমা বোধের অতলে টোকা দেয়। সে বোধ কখনও কখনও ঘাপটি মেরে থেকে ক্রমশ দর্শককে আক্রান্ত করে, এবং এভাবেই একটি সিনেমা হয়ে ওঠে দর্শকের ব্যক্তিগত তেপান্তর, যেখানে সে নিঃশ্বাস নেয়, ঘুরে বেড়ায়। শুদ্ধ সিনেমা চৈতন্য, আবেগ ও অনুভূতিতে যে দাগ কাটে তা ভাষায় প্রকাশ সম্ভব নয়। ভাষা তো অন্য শিল্পকে ধারণ করে, যেমন সাহিত্য। মানুষের চেতনাকে যুক্ত করার সহজতম এবং শক্তিশালী উপায় গল্প বলায়, তাই প্রায় সব সিনেমাই গল্প থাকে।
ছবির প্রতিটি চরিত্রের আছে নিজস্ব গল্প। শহীদ, সিরাজ, নুরু ও হুসাইন বাঁশের ভেলা টেনে নিয়ে যায়। তাদের ব্যক্তিগত জীবনে প্রধানত ভাটা, কখনো মৃদু জোয়ার।
‘বাঁশ বৈভব’-এ একটি গল্প আছে। শাহীন একটি গল্প বলেন—বাঁশমহাল থেকে বাঁশ কেটে নদীতে ভাসিয়ে বন্দরে বন্দরে বিক্রি করা, এক হাত থেকে আরেক হাতে বাণিজ্যের নিয়মে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার গল্প। এ গল্পের পরতে পরতে আছে লেয়ার, যার প্রত্যেকটি নিয়েই ভিন্ন ভিন্ন সিনেমা হতে পারে। ছবির প্রতিটি চরিত্রের আছে নিজস্ব গল্প। শহীদ, সিরাজ, নুরু ও হুসাইন বাঁশের ভেলা টেনে নিয়ে যায়। তাদের ব্যক্তিগত জীবনে প্রধানত ভাটা, কখনো মৃদু জোয়ার। শহীদের স্ত্রী আগুনে পুড়ে মারা গেছে, ঘরে তার শিশুসন্তান বাবার অপেক্ষায়। সিরাজের আয়–উন্নতি নেই, স্ত্রী সংসার আগলে রাখে। অবসর নেওয়ার বয়সেও নুরুর পরিশ্রমের ঘাম ঝরে পড়ে নদীর জলে। বারবার নদীভাঙনে বসত হারাবে, এটাই যেন হুসাইনের কপালের লিখন। এরা সবাই জলের মানুষ, জল তাদের জীবিকার ভরসা ও উপায়। অন্যদিকে জঙ্গলে অমানুষিক পরিশ্রম করে লিয়াকত ও তার সঙ্গী বাঁশ শ্রমিকেরা। এরা পরিশ্রমী, মুখে দাঁ কামড়ে দু’হাতে বাঁশ বয়ে নিয়ে যায় লিয়াকত। এই দাঁ লিয়াকতের অস্তিত্বের সম্প্রসারণ, এর সঙ্গে বাঁশ শ্রমিকদের জৈবিক সম্পর্ক, যা নিষ্ঠুরতায় ব্যবহারের জন্য নয়, এটা জীবিকার হাতিয়ার। জঙ্গলে অমানবিক পরিশ্রম করে লিয়াকত ও তার সঙ্গী বাঁশ শ্রমিকেরা। এই মানুষেরা জল ও জঙ্গল থেকে মুক্তি চায়। কেউই তাদের সন্তানদের এ পেশায় রাখতে চায় না। জল ও জঙ্গল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য সন্তানদের লেখাপড়ায় উৎসাহ দেয় তারা, যে লেখাপড়ার সুযোগ তাদের হয়নি। শাহীন এ রকমই একটি ন্যারেটিভের বুননে বাঁশ বৈভব গড়েছেন।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: