যশোর পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির দুই কোটি টাকার সরঞ্জাম আত্মসাতের অভিযোগ 

মনিরামপুর প্রতিনিধি।। | প্রকাশিত: ৫ জানুয়ারী ২০২৫ ২১:০৩

মনিরামপুর প্রতিনিধি।।
প্রকাশিত: ৫ জানুয়ারী ২০২৫ ২১:০৩

ফাইল ফটো

মনিরামপুর (যশোর)।। যশোরের মনিরামপুরে বিদ্যুতের লাইন নির্মাণের জন্য কার্যাদেশ পাওয়া তিন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রায় ২ কোটি টাকার সরঞ্জাম আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে। কাজ শুরুর নির্ধারিত সময়ের প্রায় দুই বছর পেরিয়ে গেলেও তারা যশোর পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি-২ কার্যালয়ে এসব জমা দেননি। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে (আরইবি) সুপারিশ করেছেন কর্মকর্তারা।

এসব অনিয়মের পেছনে অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে অপর ঠিকাদার কাজী মনিরুজ্জামানের নাম। তিনি স্থানীয়ভাবে আওয়ামী যুবলীগের রাজনীতিতে জড়িত। তাঁর চেনা লোকেরা জানিয়েছেন, এক সময় মনিরামপুর পৌর শহরে হোটেল কর্মচারী ছিলেন মনিরুজ্জামান। পরে পল্লীবিদ্যুতের ঠিকাদারদের অধীন শ্রমিকের কাজ নেন। কিন্তু যুবলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার পর তাঁর ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্যের ভাগনে উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক উত্তম চক্রবর্তী বাচ্চুর ছত্রছায়ায় থাকতেন মনিরুজ্জামান। সেই সুবাদে সমিতির সদরদপ্তরের কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। এক পর্যায়ে তিনি পল্লীবিদ্যুতের ঠিকাদারি কাজের জন্য মেসার্স মুবিন এন্টারপ্রাইজ নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে নিবন্ধন করেন। এর পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সমিতির তৎকালীন অসাধু কর্মকর্তাদের হাত করে দুর্নীতির মাধ্যমে কোটিপতি বনে যান মনিরুজ্জামান।
২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুতের লাইন নির্মাণের কাজ বাগিয়ে নেন কাজী মনিরুজ্জামান। তাঁর নিজের মেসার্স মুবিন এন্টারপ্রাইজের পাশাপাশি এসব কাজ পায় মাগুরার আব্দুল্লাহ এন্টারপ্রাইজ, চুয়াডাঙ্গার জীবননগরের মেসার্স মারিয়ান এন্টারপ্রাইজ ও ঢাকার মেসার্স এমবি পাওয়ার। ২০২২ সালের ২৯ অক্টোবর তাদের বিপরীতে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকার নাট, বোল্ট, তারসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম বরাদ্দের কার্যাদেশ দেয় যশোর পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি-২।

জানা যায়, প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মেসার্স মারিয়ান এন্টারপ্রাইজ, এমবি পাওয়ার ও আব্দুল্লাহ এন্টারপ্রাইজের প্রতিনিধি করা হয় মনিরুজ্জামান, তাঁর দুই সহযোগী সাইফুল ইসলাম (মেসার্স আনজুমান করপোরেশন) ও মেহেদী হাসান টুটুলকে (এস এস এন্টারপ্রাইজ)।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কার্যাদেশ পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করে কার্যাদেশের ক্লোজআউট করার নিয়ম। কিন্তু দুই বছর পেরিয়ে গেলেও লাইন নির্মাণ সম্পন্ন হয়নি। কাজী মনিরুজ্জামান অন্যদের সহায়তায় সমিতির সরঞ্জাম উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন। বৃহস্পতিবার সমিতির ডিজিএম (টেকনিক্যাল) শরীফ লেহাজ আলী বলেন, অনেক চাপাচাপির পর গত ৪ ডিসেম্বর মনিরুজ্জামান মেসার্স মুবিন এন্টারপ্রাইজের নামে বরাদ্দ প্রায় দেড় কোটি টাকার সরঞ্জাম ফেরত দিয়ে ক্লোজআউট করেন। কিন্তু অন্য তিনটি লাইসেন্সের বিপরীতে নেওয়া ১ কোটি ৯৪ লাখ ২১ হাজার ২৭২ টাকার সরঞ্জাম পাওনা রয়েছে। এর মধ্যে মেসার্স মারিয়ান এন্টারপ্রাইজের নামে ৮৩ লাখ ২২ হাজার ৬৯০ টাকা, মেসার্স এমবি পাওয়ারের নামে ৭৯ লাখ ৩ হাজার ৮৩৫ টাকা ও মেসার্স আব্দুল্লাহ এন্টারপ্রাইজের নামে ৩১ লাখ ৯৪ হাজার ৭৪৭ টাকার সরঞ্জাম তোলা হয়। এসব সমিতিতে ফেরত না দিয়ে মনিরুজ্জামান টালবাহানা করছেন।
মেসার্স মারিয়ান এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী হাবিবুর রহমানের ভাষ্য, তাঁর লাইসেন্সের প্রতিনিধি মুবিন এন্টারপ্রাইজের মনিরুজ্জামান। তিনিই এসব সরঞ্জাম তুলেছেন। এর বেশি কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন হাবিবুর। মেসার্স এমবি পাওয়ারের স্বত্বাধিকারী বাঁধন কানাই সাহা ও মেসার্স আব্দুল্লাহ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী হাফিজুর রহমান বলেন, তাদের লাইসেন্সের প্রতিনিধি করা হয় মেসার্স আনজুমান করপোরেশনের সাইফুল ইসলাম ও এস এস এন্টারপ্রাইজের মেহেদী হাসান টুটুলকে। তারা মেসার্স মুবিন এন্টারপ্রাইজের মনিরুজ্জামানের সহযোগী। কাজী মনিরুজ্জামানই সহযোগীদের নিয়ে এসব সরঞ্জাম তুলে নিয়েছেন।

হাফিজুর রহমানের অভিযোগ, সরঞ্জাম জমা দিয়ে তাদের লাইসেন্স দুটি ক্লোজআউট করতে
চাপ দিয়েছিলেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মনিরুজ্জামান ও তাঁর সহযোগীরা সমিতির সদরদপ্তরে না আসতে হুমকি দিয়েছে।
মারিয়ান এন্টারপ্রাইজের প্রতিনিধি মেহেদী হাসান টুটুল নিজেকেও ঘটনার শিকার বলে দাবি করেন। তাঁর অভিযোগ, রাজনৈতিক প্রভাব দেখিয়ে মনিরুজ্জামান তাঁর কাছ থেকে জোর করে সই নিয়েছেন। পরে সব সরঞ্জাম সমিতি থেকে তুলে মনিরুজ্জামান আত্মসাৎ করেছেন।
মুবিন এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী কাজী মনিরুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, তিনটি লাইসেন্সের বিপরীতে নেওয়া ১ কোটি ৯৪ লাখ ২১ হাজার ২৭২ টাকার সরঞ্জাম শিগগিরই ফেরত দিয়ে ক্লোজআউট করবেন। অন্যান্য বিষয়ে কথা বলতে চাননি। বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) তদন্তে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা মিলেছে বলে নিশ্চিত করেন যশোর পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি-২ এর জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) আবদুল লতিফ। তিনি বৃহস্পতিবার সমকালকে বলেন, ডিসেম্বরেই তারা মনিরুজ্জামানসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে আরইবিকে সুপারিশ করেছেন। শিগগিরই তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আশা করছেন।

©




আপনার মূল্যবান মতামত দিন: