প্রদীপের নিচে এখনো অন্ধকার

দৈনিক সমসাময়িক নিউজ ডেস্ক।। | প্রকাশিত: ১১ মার্চ ২০২৩ ০৯:১৩

দৈনিক সমসাময়িক নিউজ ডেস্ক।।
প্রকাশিত: ১১ মার্চ ২০২৩ ০৯:১৩

ছবি- মাহমুদা রিনি

মাহমুদা রিনি: ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সারাবিশ্বে দিবসটি পালিত হয় সাড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে। পিছনে ফেলে আসা দুর্গম পথ আর সামনে এগিয়ে চলার দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে নারীর জন্য একটি বিশেষ তারিখ মনে করিয়ে দেয়। সত্যিকার অর্থে দিনটি একটি মাইল ফলক, যা থেকে নারী সামনে চলার প্রেরণা পায়। মানবাধিকারের দাবিতে সংগঠিত আন্দোলনের গতিতে নতুন মাত্রা যোগ হয়।

'নারী অধিকার মানবাধিকার' এই শ্লোগান নিয়ে বার বার লিখতে যেয়ে হয়তো অজান্তেই মনের ভেতর স্বপ্ন তৈরি হয়, এই বোধহয় সর্বত্র নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে! আর কোনো প্রতিবন্ধকতা নারীকে পিছিয়ে দিতে পারবে না। নারী নিশ্চয় তার অধিকারের জায়গা এতদিনে নিশ্চিত করেছে। এমন স্বপ্নকে সত্যি ভেবে আত্মতুষ্টির মতো একধরণের তৃপ্তি পেতে মন তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠে। হয়তো সমাজের মুষ্টিমেয় কিছু নারীর স্বাবলম্বী হওয়ার দৃষ্টান্তও এমন ভ্রান্তির কারণ হতে পারে। আমাদের সমাজে পারিবারিকভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত বা দৃঢ় মনোবল ও নিজের যোগ্যতায় অনেক নারী সমাজে, কর্মক্ষেত্রে জায়গা করে নিয়েছেন। তারা শিক্ষার সুযোগ, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছেন। আবার কেউ পারিবারিক ভাবেও সুখে আছেন। তাদের আত্মতুষ্টি দেখলে মন ভালো হয়। সমাজে আর কোনো অসামঞ্জস্যতা চোখে পড়ে না।
আবার অনেক প্রতিষ্ঠিত নারীব্যক্তিত্বও আছেন, যারা সমাজের সকল প্রকার অসংগতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে চলেছেন। যারা সংগ্রাম করেই নিজের জন্য জায়গা করেছেন, পিছিয়ে পড়া নারীর জন্যও জায়গা করে দিচ্ছেন। তাঁদেরকে আমরা সম্মান জানাই! অতীতের এইসব আলোকোজ্জ্বল মহীয়সী নারীর প্রতিবাদ, সংগ্রামের ফলস্বরূপ আজ নারী দিবস পালিত হচ্ছে। আমরা কথা বলতে পারছি! তাঁদের ত্যাগ,সংগ্রাম এবং আন্দোলনের ফলেই আজ নারীর জন্য সাহস করে লিখতে পারছি, সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে রাজপথে নামতে পারছি।
কিন্তু এখানেই দায়িত্বের শেষ নয়, নারী দিবসের তাৎপর্য বা ইতিহাস লেখা হবে চিরকাল, সেই ব্যাখ্যায় যেতে চাইছি না! প্রদীপের নিচে এখনো যে গাঢ় অন্ধকার রয়ে গেছে সেটা তুলে ধরাই জরুরি মনে হয়েছে। যারা আলোয় উঠে এসেছেন তাদের দায়িত্ব অনেক। তাদের আজকের অবস্থানে আসা যাঁদের অবদানে সেই আদর্শ মনে রেখে দায়িত্ব নিতে হবে। আমাদের মনে রাখা দরকার যে একটি নারীর উঠে আসার পিছনে কতশত বছরের সংগ্রাম নিহিত আছে। মাত্র দুশো বছর আগেও নারীর অবস্থান কেমন ছিল! এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমার ইতিহাস মাথায় রেখে যদি আমরা এগিয়ে যায় তাহলে সামনের বাধা পেরনোর শক্তি ও প্রেরণা পাব। নারী-পুরুষ যে- যে অবস্থানেই থাকুন আমাদের দায়বদ্ধতা রয়েছে এখনো যারা নিষ্পেষিত তাদেরকে তুলে আনার। তাদের রক্ষা করার। প্রশ্ন আসতে পারে কারা এখনো নিষ্পেষিত! সবই তো চমৎকার চলছে! সবই তো সুন্দর দেখা যায়! এই দেখার দৃষ্টি এবং মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি তীক্ষ্ণ করা দরকার। নারীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই অনেক সময় মনে হয়– নারী বড্ড কাছে দেখে, দীর্ঘদিনের অবহেলা ও বিভিন্ন পরিস্থিতির চাপে দূরদৃষ্টি কমে যাওয়ায় খুব অল্পতে রুষ্ট-তুষ্ট হয়ে যায়। শাড়ী, গয়না আর সমালোচনা, তাও নারীর বিরুদ্ধে নারী, এই গণ্ডীর বাইরে এখনো নারীর একটা অংশ ভাবতেই পারে না! পরিবারের মধ্যে থেকেও যে মানুষের জন্য কাজ করা যায়, আত্মশুদ্ধি ও সুদূরপ্রসারী চিন্তা করা যায়। নারীকে নিজের প্লাটফর্ম মজবুত করতে হবে। অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। একা একজন নারীর অধিকার অর্জন সামগ্রিক নারী অধিকার অর্জন নয়। এখনো অনেক দূর যেতে হবে। অনেক বাধা ডিঙোতে হবে। ভিতরে ভিতরে এখনো নারীর প্রতি অজস্র সহিংস ঘটনা ঘটে চলেছে যা অনেক সময় খোলা চোখে দেখা যায় না।
একটা ঘটনার উল্লেখ করি, শোনা ঘটনা, বিস্তারিত যতটুকু জানতে পেরেছি, মেয়েটির দশ এগার বছর বয়স। বাবা ভ্যান চালায়, মা ক্ষেতে মজুরির কাজ সহ নানান ধরনের কাজ করে। প্রতিবেশী এক লোক, মোটামুটি বয়স্ক, বউ-বাচ্চা আছে সে কোনোভাবে ডেকে নিয়ে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে। এই ঘটনা কেউ একজন দেখে স্থানীয় থানায় খবর দেয়। পুলিশ তাৎক্ষণিক ভাবেই আসামীকে গ্রেপ্তার করে এবং মেয়েটিকে নিয়ে আসে পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য। মেয়েটি বর্তমানে নিরাপদে রয়েছে। আসামি গ্রেপ্তার সহ এই পর্যন্ত মোটামুটি বিচারিক প্রক্রিয়ায় আছে।
এবার আসি ঘটনার উল্টোদিকে কী হচ্ছে! গ্রামে শুরু হলো এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমালোচনার ঝড়। যত দোষ মেয়েটার। মেয়েটাকে ডেকেছে তাই বলে মেয়েটা গেল কেন! মেয়েটা যথেষ্ট হ্যাংলা, আর কাউকে ডাকে না ওকে কেন ডাকলো! এর ওর বাড়ি ছোটোখাটো কাজ করে, দুচার টাকা দিলে দোকান থেকে এটাসেটা কিনে খায়, ওর লোভ বেশি! ওরা যে আইনের আশ্রয় নিল ও মেয়ে বিয়ে দিতে পারবে! ও মেয়েকে বিয়ে করবে কে? ইত্যাদি ইত্যাদি। গ্রামের মানুষ চিন্তিত এই লোকের (ধর্ষকের) শাস্তি হলে তার পরিবারের কী হবে!
আমি হতবাক হয়ে শুনছি আর ভাবছি কোন আজব দেশে বাস করি! একটা দশ বছরের মেয়ের দোষ তাকে ডাকলে সে গেল কেন! যেহেতু তাকে ডাকলেই সে গিয়েছে অর্থাৎ তাকে ধর্ষণ করা যায়! বিচার করতে গেলে গেলে ধর্ষকের পরিবারের ক্ষতি হবে গ্রামের মানুষ চিন্তিত, আর ছোট্ট এই মেয়েটির শারীরিক, মানসিক যে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে গেল। যে ট্রমা থেকে তার হয়তো অনেক বড়ো ক্ষতি হয়ে যেতে পারে সে কথা কেউ একবারও ভাবছে না। আইন নিশ্চয় আইনের গতিতে চলবে। বিচার হবে বা শাস্তিই হলো মেয়েটার মানসিক বিপর্যয় কি কেউ বুঝতে পারবে? মেয়েটির বাবা-মা ঘর থেকে বের হতে পারছে না লজ্জায়! তারা জমিজমা বিক্রি করে ঐ এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবছে! গ্রামের মানুষ তাদের নানারকম ভয় দেখাচ্ছে। টাকা দিয়ে পুরো ঘটনাটা চাপা দেয়ার চেষ্টাও চলেছে। একবার ভাবুন তো মেয়েটি ঐ পরিবেশে টিকবে কী করে? ওকে প্রতি মুহূর্তে ধর্ষণের শাস্তি পেতে হবে। ওর আগামী জীবন এটা মনে করিয়ে ওকে তছনছ করা হবে। কোনো আইন, আইনের কোনো মাধ্যম এই মেয়েটির দুরবস্থা থেকে তাকে বাঁচাতে পারবে না। এমনকি মেয়েটির মা মেয়েটিকে দোষারোপ করে গালিগালাজ করে এবং করবেও সারাজীবন। এটাই সামাজিক অশিক্ষা ও হীনমন্যতার প্রকট বাস্তবতা! ঘটনার সত্যতা স্থানভেদে কমবেশি যা-ই হোক না আমাদের দেশে যে হাজার হাজার ধর্ষণ, গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে সবখানে প্রায় একই চিত্র দেখা যায়।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আমরা বিশ্বব্যাপী যতই বেগুনি রঙে সেজে উঠি না কেন আমাদের চারপাশে লক্ষ কন্যাশিশু, হাজারো মা বোন অপমানে লজ্জায় মুখ লুকিয়ে কাঁদে। আমাদের কত কন্যাশিশু অচেনা অব্যক্ত যন্ত্রণায় ছটফট করে, যে যন্ত্রণার কারণ বোঝার বয়স তখন তার হয়নি! সবচেয়ে বড়ো কষ্টের কারণ হলো এই মেয়েগুলি সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত হয় নারীদের দ্বারাই! নারীরাই তাদের কন্যাতুল্য মেয়েটির কষ্টের জায়গাটিতে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে।
এর কী কোনো প্রতিকার নেই! আছে কী নেই পরের কথা আমরা কী সত্যি প্রতিকার চাই? আইনি বিচার যদি পায়ও সামাজিক নিগ্রহ থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় আছে কী? সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে গুটিকয়েক সংগঠনের উঠোনবৈঠক, প্রতিবাদ মিছিল, মানববন্ধন এই দেয়াল ভাঙতে পারবে না। সামাজিক শিক্ষা ও পারিবারিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। প্রতি পাড়ায়, প্রতি মহল্লায়, মসজিদের খুৎবায়, স্কুলে, ওয়াজ মাহফিলে বা নতুন কোনোভাবে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া অত্যন্ত জরুরি আমরা যদি সভ্য জাতি হিসেবে পরিচয় দিতে চাই!
নারী দিবসের তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য সফল হোক।




আপনার মূল্যবান মতামত দিন: