সাংবাদিকের নয়নে একজন তরিকুল ইসলাম

দৈনিক সমসাময়িক নিউজ ডেস্ক। | প্রকাশিত: ৫ নভেম্বর ২০২৫ ২১:২১

দৈনিক সমসাময়িক নিউজ ডেস্ক।
প্রকাশিত: ৫ নভেম্বর ২০২৫ ২১:২১

ফাইল ফটো

সাংবাদিকের নয়নে একজন তরিকুল ইসলাম

বর্ষিয়ান রাজনীতিক তরিকুল ইসলাম শুধু যশোরসহ দক্ষিন বঙ্গের উন্নয়নের কারিগরই ছিলেননা। তিনি ছিলেন সাংবাদিকদের মাথার মণি। পেশাদার সাংবাদিক না হলেও তিনি সব সময়ই বস্তনিষ্ট সাংবাদিকতাকে শ্রদ্ধা করেছেন, করেছেন পৃষ্ঠপোষকতা।সাংবাদিকদের বিপদে আপদে তিনি ছিলেন একজন অপ্রতিম বন্ধু। সাংবাদিকদের ভালবেশে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন প্রতিশ্রæতিশীল দৈনিক লোকসমাজ। লোকসমাজ ছিল তার হৃদয়ের স্পন্দন। যেমন একজন মা তার সন্তানদের বুকে আকড়ে লালন-পালন করে। ঠিক তেমনি তিনি লোকসমাজ ও তার সাংবাদিকদের একইভাবে পালন করতেন।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের দু:শাসনের সময় গনতন্ত্রকামী নির্যাতিত মানুষ ও সমাজের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে তিনি ৩০ অক্টোবর প্রতিষ্ঠা করেন দৈনিক লোকসমাজ। তরিকুল ইসলামের বাসনায় তৃপ্ত হয়ে যশোরের প্রথিতযসা সাংবাদিক ফকির শওকতের সম্পাদনায় আইয়ুব হোসেন,আনোয়ারুল কবির নান্টু, তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু, মোস্তফা রুহুল কুদ্দুস, মিজান মাহমুদ, রাজেক জাহাঙ্গীর, আব্দুল্লাহ হুসাইন, সিদ্দিক হোসেন, সাইফুর রহমান সাইফ, হানিফ ডাকুয়া, সাইফুল ইসলাস সজল, জাহিদ আহমেদ লিটন,মিজানুর রহমান, এসএম সোহেলসহ একঝাঁক তরুন ও কর্মঠ সাংবাদিক লোকসমাজে যোগদিয়ে কার্যক্রমকে তরান্বিত করে। লোকসমাজের অফিস ছিল কাঠেরপুল সংলগ্ন বাবুঘাটে আব্বাস বিশ্বাস মার্কেটের দুইতলায়। তরিকুল ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতায় বস্তনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করে স্বল্প সময়ের মধ্যে পাঠকদের মন জয় করে লোকসমাজ। বিশেষ করে খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদার, চুয়াডাঙ্গার লাল্টু , সিরাজ, মনিরামপুরের মুজিবুর, কেশবপুরের হায়দার. ডুমুরিয়ার চরমপন্থি প্রশান্ত কুমার প্রোসহ মাঠকাপানো সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লোকসমাজের ধারাবাহিক সচিত্র প্রতিবেদন মানুষের মাঝে দোলা দেয়। ফলে দ্রæত সময়ের মধ্যে দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলে লোকসমাজ পত্রিকা জগতে শীর্ষস্থান দখল করে। তবে বস্তনিষ্ঠের কারনে লোকসমাজকে অনেক মাশুলও গুনতে হয়েছে। তৎকালিন আওয়ামী লীগ সরকারের খড়গ নেমে আসে লোকসমাজের ওপর। হয়রানি ও ষড়যন্ত্র করে লোকসমাজ বন্ধ করতে দীর্ঘদিন সরকারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ বন্ধ করে দেওয়া হয়। অবশ্য এ জন্য তরিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের নিয়ে দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন প্রান্তে অনেক আন্দোলন সংগ্রামও করেছেন। প্রতিমাসে তাকে গুনতে হতো লাখ লাখ টাকার ভর্তুকি। স্বৈরাচারের কোন রক্তচক্ষুর সাথে লোকসমাজ আপোষ করেনি। যদিও অনেক সাংবাদিকের ওপর হামলা, মামলাও করে তৎকালীন শাসকরা।

২০০০ সালের ফেব্রæয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে আওয়ামী সরকার যখন জননিরাপত্তা নামে নিবর্তনমূলক একটি কালো আইন পাশ করেন। একটি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ১৫ ফ্রেব্রæয়ারি মনিরামপুরে আওয়ামীলীগ ও বিএনপির মধ্যে সংঘর্ষ হয়। তখন দেখেছি পুলিশ মিমাংশার কথা বলে বিএনপির কার্যালয় থেকে ৩৬ নেতাকর্মীকে থানায় ডেকে নিয়ে আটক করেন। ওই ৩৬ জন সহ মোট ৬৮ জনের বিরুদ্ধে জননিরাপত্তা ওই কালো আইনে মামলা করেন। সংঘর্ষের সময় আমি ছিলাম থানায় ওসির (শাহ আলম) কক্ষে। তার পরও আওয়ামী লীগ নেতা গৌর ঘোষের দায়েরকৃত ওই মামলায় আমাকে ৫৯ নম্বর আসামি করা হয়। তখন আমার বড় ছেলে মেহরাবের বয়স মাত্র সাত মাস। আর কি করা পুলিশের গর্জনে আমি মনিরামপুর ছেড়ে ওই রাতেই আমাদের প্রকাশক তরিকুল ইসলামের বাসায় ছুটে যায়। সেদিন তিনি আমাকে দুরে সরিয়ে না দিয়ে সন্তানের মত বুকে জড়িয়ে ধরে আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। লোকসমাজ অফিস এবং উনার বাসায় আমার ঠায় হয়। সেখানে আমি তিনমাস অবস্থান করি। মাঝেমধ্যে বাসায় একসাথে ডাইনিং টেবিলে উনার পাশে বসে খাওয়া দাওয়া করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। যখনই দেখা হতো তখনই আমার খোঁজখবর নিয়েছেন, পাশাপাশি আমার স্ত্রী সন্তান পিতা-মাতার খবরও উনি নিতেন । তরিকুল ইসলাম হটাৎ একদিন লোকসমাজের তৎকালিন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকনের মাধ্যমে আমাকে বাসায় ডেকে নিয়ে বললেন, মজনু মামলা থেকে তোকে অব্যাহতি(তরিকুল ইসলামের তদ্বিরে) দিয়েছে পুলিশ। তুই কালই বাড়ি যাবি। আমি চলে আসলাম। তিনি শুধু আমাকে নয় এমন ঠাই দিয়েছিলেন আকরামুজ্জামান, সুন্দর সাহাসহ অনেকেরই। যখনই কোন সাংবাদিক বিপদে পড়েছে তখনই তরিকুল ইসলাম তার পাশে প্রত্যক্ষ সহযোগীতার হাত প্রসারিত করেছে। তিনি সব সময় সাংবাদিকদের বিভিন্নভাবে মূলয়ন করেছেন। ২০০১ সালে বিএনপি সরকারের আমলে পর্যায়ক্রমে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ন মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী ছিলেন। সরকারি বিজ্ঞাপন শুধু তিনি লোকসমাজকে দেয়নি। লোকসমাজের পাশাপাশি তিনি গ্রামের কাগজ, কল্যাণ, পূর্বাঞ্চলসহ অনেক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন পাঠাতেন। উনি যখন মনিরামপুরে রাষ্ট্রিয় ও দলিয় কর্মসূচিতে অংশ নিতেন। তখন দেখেছি তরিকুল ইসলাম স্থানীয় নেতৃবন্দকে দিয়ে আমাকে ডেকে কাছে নিয়ে খোজখবর নিতেন। প্রশাসনের কর্তাদের বলতেন আমার সাংবাদিকের প্রতি(মজনু) খেয়াল রাখবেন। এভাবেই তিনি সব জায়গায় সাংবাদিকদের মূল্যায়ন করতেন। শুধু তাই নয়, ২০০৪ সালে যখন আমি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চাকুরি পাই । তখন স্থানীয় ভাবে একটু রাজনৈতিক কোন্দল দেখা দেয়। একথা শোনার পর তিনি তার ছোট ছেলে অনিন্দ্য ইসলাম অমিতকে নির্দেশনা দেন সমাধান করতে। আমি দেখেছি পরদিনই অনিন্দ্য ইসলাম অমিত অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে মনিরামপুরে এসে বিষয়টি সমাধান করেন। ফলে লোকসমাজে আমার মত সব সাংবাদিক তরিকুল ইসলাম ও তার পরিবারের কাছে ঋনী। অপরদিকে বস্তনিষ্ঠ সাংবাদিকতাকে তিনি কোন ছাড় দেননি। কারো বিরুদ্ধে নিউজের সময় অবশ্যই তার বক্তব্য নেওয়ার ব্যাপারে তিনি সব সময় কড়া তাগিদ দিতেন। গাফিলতি হলে তিনি শাসনের কমতি করতেননা। পরে অবশ্য আবারও বুকে জড়িয়ে নিতেন।

তরিকুল ইসলাম দলের নেতা হলেও তিনি লোকসমাজকে কখনও দলিয় মুখপাত্র হিসেবে ব্যবহার করেনি। নিউজের ব্যাপারে বিএনপির অনেক নেতৃবৃন্দ মনক্ষুন্ন হয়ে তরিকুল ইসলামের কাছে ওই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আজ নালিশ করেছেন। কিন্ত তরিকুল ইসলাম কখনও নেতৃবৃন্দের কথায় কোন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অবস্থান করেননি।

যশোরে অবস্থানের সময় বিভিন্ন কর্মকান্ড শেষে যত রাতই হোক তরিকুল ইসলাম লোকসমাজ অফিসে না গিয়ে বাসায় ফিরেছেন এমন নজির আমি কখনও দেখেনি। লোকসমাজ অফিসে না গেলে যেন উনার পেটের ভাত হজম হতোনা। শুধু তাই নয়, আমি দেখেছি রাতে যখন মুজিবুর নিউজ পেষ্টিং করতেন তখন তরিকুল ইসলাম পেষ্টিং রুমে অবস্থান করে নিউজের হেডলাইনসহ ত্রুটি বিচ্যুতি সম্পর্কে চমৎকার পরামর্শ দিতেন। তিনি সব সময় চেয়েছেন লোকসমাজকে দলের উর্ধে রেখে বস্তনিষ্টতা আকড়ে রাখতে। তিনি সফলও হয়েছেন। নিউজের ব্যাপারে সাংবাদিকরা ছিল স্বাধীন। আর এসব কারনে তিনি সবসময় সাংবাদিকদের চোঁখের মণি হিসেবে থাকবেন চিরদিন। বর্তমান সাংবাদিকদের কাছে একজন তরিকুল ইসলামের শুণ্যতা কখনও পুরনীয় নয়। তিনি আজ নেই কিন্তু তার বর্নাঢ্য স্মৃতি নিয়ে আজও লোকসমাজের অনেক সাংবাদিক নিরলসভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। তরিকুল ইসলামের ৭ম মৃত্যু বার্ষিকীসহ সব সময় আল্লাহপাকের দরবারে প্রার্থনা করি উনি যেন বেহেশতের সর্বচ্চো স্থানে আসিন হন। যদিও তার অবর্তমানে তার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে লোকসমাজের প্রকাশক শান্তনু ইসলাম সুমিত ও নির্বাহী সম্পাদক বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক(ভারপ্রাপ্ত) অনিন্দ্য ইসলাম অমিত পিতার ন্যায় লোকসমাজের সাংবাদিকদের সুখেদুখে পাশে রয়েছেন। তরিকুল ইসলামের যোগ্য উত্তরসুরী হিসেবে তাদের দীর্ঘায়ু ও সফলতা কামনায় আমাদের অনরূপ দোয়া রইলো।

লেখক,
এস এম মজনুর রহমান।
সভাপতি
মনিরামপুর প্রেসক্লাব।

 




আপনার মূল্যবান মতামত দিন: