
মোঃ শাহ্ জালাল।। পানিতে তলিয়ে গেছে পাকা ধানক্ষেত, ওপরের অংশ কেটে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা কৃষকদের। সারাদেশে একদিকে বেড়েই চলেছে রাজনৈতিক অস্থিরতা অপরদিকে প্রতিবারের ন্যায় এবার বন্যায় প্লাবিত দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। যশোরের মণিরামপুর উপজেলার কৃষকরা দাঁড়িয়ে আছেন চরম অসহায়ত্বের মুখোমুখি। হোগলাডাঙ্গা, বাহাদুরপুর, হাজিরহাট, নেবুগাতী, কাটাখালি, গোপালপুরসহ উপজেলার ৯৬ এলাকার বহুবিলে ছিল ধানের ক্ষেত। ইরি পরবর্তী রোপন কৃত এই ধান এখন প্রায় পরিপক্ব হতে শুরু করেছে। এমন সময় অতিবৃষ্টির কারণে হরিহর ও মুক্তেশ্বরী নদীর বুক চিরে হঠাৎ করেই নেমে এসেছে আগাম বন্যা। মাত্র এক থেকে দুই দিনের ব্যবধানে বিলাঞ্চলে ঢুকে পড়েছে বন্যার পানি। মুহূর্তেই পানির নিচে তলিয়ে গেছে সোনালি রঙের পাকা ধানের ক্ষেত।
এলাকার ফসলি জমি এখন জলমগ্ন। শত শত হেক্টর জমির পাকা ধান পানির নিচে। কৃষকের দীর্ঘদিনের ঘাম, স্বপ্ন আর অপেক্ষার ফসল আজ ভাসছে সেই পানির স্রোতে। অপরদিকে হাজার হাজার একর ঘের ভেসে গেছে কৃষকের। ফলে শ্রমিক সংকট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে কৃষকের দুর্দশা। দিনে ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা মজুরি দিয়েও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। দূর্বিষহ আবহাওয়ায় বাড়ছে সর্দি কাশি জ্বর ফলে কেউ কেউ এমন দুরূহ পরিবেশে কাজ করতে অনিচ্ছুক। ফলে বাধ্য হয়েই কাস্তে হাতে নিজের ধান নিজেই কাটতে নেমেছেন অনেক কৃষক। পরিবারের সঙ্গে সময় না কাটিয়ে মাঠে দাঁড়িয়ে তারা চেষ্টা করছেন যতটা সম্ভব ধান ঘরে তোলা যায়।
বাহাদুরপুর গ্রামের কৃষক হরে কৃষ্ণ বলেন, ‘কয়েকদিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে, আমরা ভাবছিলাম ১৫-২০ দিন পরে ধান কেটে ফেলবো। হঠাৎ বানের পানি আইসা পড়লো। ক্ষেতের মধ্যে এখন কোমর পানি। জোন পাই না, পাইলেও টাকা চায় আকাশছোঁয়া।’
হরিদাস কাঠি ইউনিয়নের কৃষক মাধব মন্ডল বলেন, সামনে আসছে শারদীয় উৎসব ভাবছিলাম এবারের ধান বিক্রি করে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে হাসিমুখে উৎস পালন করবো কিন্তু সেটা আর হলইনা।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, শ্যামকুড়, হরিদাসকাটি,খানপুর, দূর্বডাঙ্গা, নেহালপুর, ঢাকুরিয়াসহ উপজেলার ৯৬ এলাকার ইউনিয়নগুলোর অনেক জমিতে এখন কোমরসমান পানি। এই পরিস্থিতিতে কিছু কৃষক পাকা ধানের ওপরের অংশ কেটে পলিথিনে ভাসিয়ে তা শুকনো স্থানে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে সমস্যা সেখানেই জমি থেকে ধান তুললেও তা শুকানোর মতো পর্যাপ্ত জায়গা বা সরঞ্জাম নেই। ফলে অনেকক্ষেত্রেই সেই ধানও নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে মোট উৎপাদনে ৯০ শতাংশ ধান কাচা যার সবটাই নষ্ট হয়ে যাবে।
উপজেলা কৃষি অফিসার মোছাঃ মাহমুদা আক্তার জানান, আগাম বন্যায় কিছু নিচু জমির ধান ডুবে গেছে। তবে আমাদের এবারে ধান উৎপাদনের লক্ষমাত্রা ছিল ৩২শ হেক্টর, অর্জন হয়েছে ৩২শ হেক্টর। তবে বন্যায় প্লাবিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫২৮ হেক্টর জমির ধান।
স্থানীয় কৃষক ও বাসিন্দারা জানান, প্রতিবছর এমন বন্যা হয় তবে এবার আগাম বন্যা। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, অনিয়মিত ও ভারী বর্ষণ, নদনদীর নাব্যতা হ্রাস সব মিলে ৯৬ এলাকায় দেখা দিচ্ছে নতুন এক বিপর্যয়।
একজন প্রবীণ কৃষক কালিপদ বিশ্বাস বলেন, ‘বছরের পর বছর আমরা বন্যার সাথে লড়াই করে ধান চাষ করি, কিন্তু এবার যে হঠাৎ এমন পানি আসবে, তা ভাবতেই পারিনি। এত কষ্টে ফলানো ধান চোখের সামনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আর আমরা কিছুই করতে পারছি না।’
মণিরামপুর উপজেলার কৃষকরা শুধু নিজেদের পরিবারের খাদ্য জোগান দেন না, দেশের খাদ্যনিরাপত্তাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এই এলাকার কৃষির ওপর নির্ভর করে হাজারো পরিবার। একটি মৌসুমের ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়া মানে শুধু আর্থিক ক্ষতি নয়, বরং খাদ্যচক্রে বড় এক ধাক্কা। এখন কৃষকরা তাকিয়ে আছেন সরকারের দিকে তাদের দাবি জরুরি সহায়তা, কৃষি যন্ত্রপাতি এবং ভবিষ্যতে এমন আগাম বন্যা মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: