আমি সমতলের মানুষ

অনলাইন নিউজ ডেস্ক।। | প্রকাশিত: ২২ মে ২০২২ ০২:৩৫

অনলাইন নিউজ ডেস্ক।।
প্রকাশিত: ২২ মে ২০২২ ০২:৩৫

মোঃ মনিরুজ্জামান

আমি সমতলের মানুষ। বাংলাদেশের পলিমাটির সোঁদা গন্ধেই আমার বেড়ে ওঠা। ছোট বেলা থেকেই মাসুদ রানা বা ওয়েস্টার্ন সিরিজ পড়ার সুবাদেই হোক বা অন্য যেভাবেই হোক পাহাড় আর তুষার কিভাবে জানি দারুন রেখাপাত করেছে এই বঙ্গ সন্তানের মনে, মানসে।

কসোভো আমার প্রথম শান্তিরক্ষা মিশন। কসোভো দেশটি পর্বতময় এবং তুষারপাত এখানকার নৈমিত্তিক ঘটনা। কসোভো মিশনে আমার দুই কলিগ রাশিয়ান সের্গেই পাসিকভ আর অষ্ট্রিয়ান চার্লস ছিল স্কিয়িং এর পোকা। প্রায়ই উইক এন্ডে আমরা টিমমেটরা কম্বাইন্ড পেট্রোলিং বা নিছক ঘোরাঘুরির জন্য প্রায়শই এদিক ওদিক যেতাম। মার্চ থেকে জুন হচ্ছে স্কি করার জন্য সূবর্ন সময়।

কসোভো মিশনে থাকাকালীন এমনি এক উইকএন্ডে প্রিস্টিনা থেকে ঘন্টা দুয়েক ড্রাইভ করে আমরা সিরিয়াস ক্রাইম্সের জনা বিশেক সহকর্মী সের্গেই আর চার্লসের পীড়াপীড়িতে হাজির হলাম এক স্কি সেন্টারে। উদ্দেশ্য স্কিয়িং এবং সাইট সিয়িং। এক শনিবার সকালে ৫/৬ টি ইউ এন কোকো কোলা লাল সাদা প্রাডো জীপে চড়ে আমরা হাজির হলাম কসোভোর অন্যতম ফেভারিট একটি স্কি সেন্টার কাম টুরিষ্ট স্পটে। যাত্রা পথ বা ডেস্টিনেশনের অপার্থিব সৌন্দর্য্যের বিবরণ দিতে আজ বসিনি, বসেছি অন্য কাজে। সে কথাই আজ বলবো।

এপ্রিলের মাঝামাঝির দিনটি ইউরোপিয়ানদের কাছে সামার হলেও মাইনাস দশ/এগারো তাপমাত্রায় ও বঙ্গ সন্তানের ত্রাহি মধু সূদন অবস্থা। স্কিয়িং এর এ, বি, সি, ডি আমি না জানলেও ভিতরে হালকা কুর কুরানি তো কিছুটা ছিলই। তার প্রভাবেই হোক আর সের্গেই এর পীড়াপীড়িতেই হোক দুগ্ধধবল, শ্বেতশুভ্র বরফ চূড়োর আকর্ষনেই হোক রঙ্গীন স্কি ড্রেস পরে দু হাতে দুই স্কি স্টিক নিয়ে উঠতে লাগলাম, সের্গেই এর পিছু পিছু।

ওদের উদ্দেশ্যে পাহাড় চূড়ো থেকে স্লাইডিং করে দুশো মিটারের মত নীচের ভ্যালি পর্য্যন্ত ডাইভিং আর আমার উদ্দেশ্যে দুচোখ ভরে রাব্বুল আলামিনের সৃষ্ট অপরূপ প্রকৃতির রূপ যতটা পারা যায় দেখে নেয়া। নভেম্বর থেকে বরফ পড়া শুরু হয়েছে কাজেই এপ্রিলে এসে বরফ বেশ পাকা, স্লাইডিং এর সম্ভাবনা কম, পায়েও ইঞ্চি দুয়েক লম্বা লম্বা হুক লাগানো স্কি বুট, দু হাতে দুই স্টিক, পাশে আছে বিশ^স্ত বন্ধু কাম সহকর্মী প্রফেশনাল স্কি এক্সপার্ট সের্গেই। কাজেই ফুরফুরা মেজাজেই উঠছিলাম।

উপরে ওঠা বরাবরই কঠিন, আমার মত নবিশের জণ্য তা আরো কঠিন,তা সে পাহাড় চূড়ায় ই হোক আর জীবনপথেই হোক।কি মনে করে যেন সেদিন মাথায় পরেছি লাল সবুজ পিক ক্যাপ পাহাড়ের মাঝ বরাবর উঠতেই হ্যাম স্টিং, থাইতে চাপ অনুভব করছিলাম।

সেই ব্যাথা নিয়েই এগুচ্ছিলাম, মাথার লাল সবুজ ক্যাপের সম্মান রাখতে গিয়ে কষ্ট হলেও মুখের হাসিটি ধরে রাখার চেষ্টা করছিলাম। সের্গেই ও বারে বারে গতি কমাচ্ছিল তার নবিশ তালবিএলেম কে সংগ দেবার জন্য। বারে বারে উপরের দিকে তাকাচ্ছিলাম চূড়া আর কত দূরে আড় চোখে তা দেখার জন্য। সাথের অনেকেই তখন দলছুট। সামনে ৩/৪ জন, পিছে পড়েছে ১০/১২ জন। ভাবলাম প্রথম প্রচেষ্টা বিবেচনায় পারফর্মেন্স খারাপ না।

আরো একটু উঠতেই চূড়া স্পষ্ট হল, কিন্তু সাধারণত যেমন হয় পর্বত শৃঙ্গে ওঠার আগের কয়েকটি ধাপে শৃঙ্গ চূড়োকে ঘিরে চারিপাশে ১০/১২ মিটার চওড়া একটা ভ্যালি পেয়ে গেলাম। এখানে শৃঙ্গকে সুন্দরভাবে প্রদক্ষিণ করা যায়। এখান থেকে পুরো উপত্যাকা পরিষ্কার দেখা যায়। এখান থেকেই নীচ ও উপর যুগপৎভাবেই স্পষ্ট দৃশ্যমান। এটিই মূলত ফটো পয়েন্ট। এখানেই পর্বতারোহীরা ছবি-টবি তোলে।

২০০৫/২০০৬ এর কথা বলছি, তখনো ফেসবুক যুগ শুরু হয়নি কিংবা সচরাচর মোবাইলেও ক্যামেরা অপশন ছিলনা। গোলাপী রঙের দারুন দেখতে স্যামসাং এর একটি ডিজিটাল ক্যামেরা ছিল আমার। সেটি বিরতিহীনভাবে চলতে লাগলো।

২০ জনের মাত্র ০৫ জন আমরা ভ্যালিতে। লিড করছে অষ্টিয়ান চার্লস, এর পর আছে ফ্রান্সের মিশেল, চাইনিজ মং, রাশিয়ান সের্গেই আর আমি। এর মধ্যে সের্গেই, চার্লস আর মিশেল প্রফেশনাল স্কি খেলোয়াড়। আমি এবং মং শিক্ষানবিশ। পায়ে, শরীরে, থাইয়ে ব্যথা কিন্তু তখনো শরীরে যতটুকু শক্তি আর মনে যতটুকু সাহস অবশিষ্ট আছে তাতে সেখান থেকে শতখানেক মিটার উচ্চতার চূড়োয় পৌঁছানো আমার জন্য যে একেবারে অসম্ভব কোন ব্যাপার এমন মনে হচ্ছিল না।

যাহোক অতি উৎসাহী হলাম না, ভাবলাম প্রথম দিন বিবেচনায় যতটুকু এসেছি তাই যথেষ্ট। সিদ্ধান্ত হল আমি আর মং এখানে বসেই ব্যাগপ্যাক থেকে বের করে জুসটুস খাবো আর ওরা বাকী ৩ জন চূড়ায় উঠে সেখান থেকে স্নো ডাইভিং করবে।

পাহাড়ের চারিদিক দিয়ে তখন পর্বতারোহীরা লাল হলুদ কমলা ড্রেস পরে উঠছে, নামছে। নীচের রাস্তা যদিও খালি চোখে তখনো দেখা যাচ্ছে কিন্তু চলন্ত গাড়ীগুলোকে খেলনা গাড়ীর মত ছোট মনে হচ্ছে।
দূর দেশের সুপ্রশস্ত সেই তুষার উপত্যকায়, সেই নির্মোহ নির্জনতায় বসে অদ্ভুত এক প্রশান্তি এলো মনে। যাকে বলে শান্ত আত্মার টেকসই স্বাচ্ছন্দ্য। সামনে এগিয়ে যাচ্ছে অগ্রসর অভিযাত্রীরা,পিছনে রয়ে গেছে ক্লান্ত বিধ্বস্ত পরিপ্রাজকের দল।

বিগত এগারোই মে বাংলাদেশ পুলিশের ডিআইজি পদে পদোন্নতি পেলাম। পদোন্নতির তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়াটি ও ঠিক এমনিই ছিল। মনে হল অনেক পথ পাড়ি দিয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ পাক পতটুকু সম্মান, স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছেন তাতেই যায়পরনাই সন্তুষ্ট ।

মনে হল সমুখে রয়েছে পথ কিন্তু পেরিয়েও এসেছি অনেকটাই। এই বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে যারা সহায় হয়েছেন, সাহস দিয়েছেন, পাশে থেকে কাঁধে হাত রেখেছেন তাদের সকলকে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। কেউ কেউ যে পা টেনে ধরে ফেলে দিতে বা থামিয়ে দিতে চাননি এমন নয়। তাদের প্রতিও আমার অসীম কৃতজ্ঞতা। টেনে ধরার, ফেলে দেবার, ল্যাং মারার, বিভ্রান্ত করার বন্ধুদের উপস্থিতি আমাকে আরো সতর্ক ও শানিত করেছে সন্দেহ নেই।

পরোয়ারদিগার সহায় ছিলেন, মানুষের ভালবাসা ছিল, শুভ কামনা ছিল,তার উপর ভর করেই কর্ম জীবনের একটা পর্য্যায়ে আসতে পেরেছি। যেখানে পৌঁছতে পেরেছি সেখান থেকে পাহাড় চূড়ো সহজেই দেখা যায়, আরো ভালভাবে দেখা যায় পিছনের জনস্রোত, যারা যোগ্যতা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতায় কোন অংশেই আমার চেয়ে কম নন। তাদের জন্যও আমার অন্তহীন শুভ কামনা। তাদের যাত্রা নির্বিঘ্ন হোক, সফল হোক, কামনা করি।

মানুষের বিজয়ের দিনে সবাই তাকে অভিবাদন জানায়। সে কারনেই বিজয়ের দিন বন্ধু চেনার উপযোগী দিন নয়। তারপরও পুলিশের চাকরিতে এই ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ ২৩ বছরে কম মানুষকে তো দেখিনি। ভুল ত্রুটি হতে পারে, কিন্তু মোটামুটি বুঝতে পারি কার শুভেচ্ছা জেনুইন, কারটা নিছক ফর্মালিটি আর কারটা মুখে মধু অন্তরে বিষ।

পদোন্নতির পর আমার এক অন্তর্মুখী চরিত্রের বন্ধু তার ওয়ালে লিখেছিলেন, ‘‘ I believe in the power of players, and your prayers made me DIG.
তার সাথে সুর মিলিয়ে বলি, আই বিলিভ ইন দি পাওয়ার অব প্রেয়ারস, পাওয়ার অব গুড সোলস।

যাত্রাপথে যারা অকারনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন, অযৌক্তিকভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন তাদের উদ্দেশ্যে আমার প্রয়াত মায়ের প্রায়শই বলা একটা কথা বলি ‘‘রাখে আল্লাহ মারে কে?’’ ভাইয়েরা আমার, বন্ধুরা আমার আসুন সহযাত্রী হই, আমাদের জার্নিটাকে এনজয় করি, একসাথে আলো ছড়াই, সুগন্ধ বিকাই।

সুদান মিশনে আমার এক ইন্দোনেশিয়ান কলিগ ছিলেন, জেমসন বোকো। সুদর্শন, চটপটে প্রানখোলা বোকোকে প্রশংসা করার অনেক কারন ছিল। ওকে প্রশংসা করলেই ও ভুবনভুলানো হাসি দিয়ে একটা কথা বলতো, ওর নিজের, নাকি কোন মনীষির জানিনা। ও বলতো I am a very ordinary man, some extra ordinary good souls helped me to do something unique.

সরকারী চাকুরীতে প্রমোশন একটি গতানুগতিক প্রক্রিয়া। একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর বয়স, যোগ্যতা, দক্ষতা ও কমিটমেন্টের ভিত্তিতে কর্মচারীরা উচ্চতর ধাপে যাবেন এটিই স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিক বিষয়টিকে নিয়ে আমার সব ধরনের প্রিয়জনেদের যে উচ্ছাস আমি দেখেছি তার যোগ্য আমি নই। আমি বিস্মিত, গর্বিত, অভিভূত, হতবিহব্বল, আনন্দ আপ্লুত আমার পদোন্নতিতে আমার প্রিয়জনদের আনন্দে, উচ্ছাসে, বাঙময়তায়।

আপনাদের সকলের কাছে আমি ঋণী। আক্ষরিক ভাবেই ঋনী। সরাসরি, দেখা সাক্ষাতে, ফোনে, মেসেজে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাখো সুহৃদ আমাকে অভিনন্দন, দোয়া ও শুভ কামনা জানিয়েছেন। ফুলেল সুগন্ধে, কেকে, মিষ্টিতে উপছে পড়েছে আমার বাসা, অফিস, গাড়ী, প্রাঙ্গন। বিনয় করে নয়, সত্যি করেই বলছি এত কিছুর যোগ্য আমি নই।

গত কয়েক মাস ধরেই প্রমোশনের ইস্যুটি আলোচিত ছিল। পুলিশ সার্ভিসের পিরামিড শেইপের কারনে বিগত কয়েকটি ব্যাচেই গড় পড়তা ২৫-৩০% এর বেশী কর্মকর্তাকে ডিআইজি পদে পদোন্নতি দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। সেটি একটি স্ট্রেস।

আমি সাধারনত বাসা আর অফিস মিলিয়ে ফেলিনা। অফিসের স্ট্রেস বাসায় ঢুকাতে চাইনা।
কিন্তু পরিবার এমন একটি স্বত্বা নিজের সাথে যে স্বত্বার কোন দেয়াল রাখা চলেনা। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আমার স্ট্রেস আমার স্ত্রী সন্তান ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকেও প্রভাবিত করেছে। আমি সবসময়ই পছন্দ করি অন্যকে নিয়ে ভাবতে আমাকে নিয়ে কাউকে ভাবতে হোক এটা চাইনা। আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত যে, আমাকে নিয়ে আমার প্রিয়জনদেরকে স্ট্রেস নিতে হয়েছে।

আমি সকলের কাছেই কৃতজ্ঞ। বিভিন্ন শ্রেনি পেশার এত অধিক সংখ্যক মানুষ আমাকে নানা মাধ্যমে শুভেচ্ছা, দোয়া ও অভিনন্দন জানিয়েছেন, এমন সব শব্দ, বাক্য, বিশেষণ ব্যবহার করেছেন যার যোগ্য আমি নই।

এগুলো নিতান্তই আমার প্রতি তাদের স্নেহ, মায়া ও ভালবাসা। প্রবল ইচ্ছা থাকা স্বত্বেয় অধিকাংশ সুহৃদের শুভেচ্ছার প্রতি উত্তর আমি দিতে পারিনি, সম্ভব হয়নি। যদিও আমি জানি সত্যিকারের স্নেহ সব সময়ই নিঃশর্ত। কাজেই আমার নীরবতায় তারা ব্যথিত হবেন না বা আমার প্রতি তাদের শুভ কামনা এবং দোয়ার ও হেরফের হবেনা।

আমি আপনাদের সকলের কাছে পর্বতসম ঋনে ঋনী, এবং ক্ষমাপ্রার্থী। আমাকে দয়া করে ক্ষমা করবেন, স্নেহের ছায়ায় রাখবেন, দোয়া রাখবেন। আপনাদের সকলকে আমরা আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধা। রাব্বুল আলামিন আপনাদের সকলের সর্বোত্তম সহায় হোন। আপনাদের সকলের কাছে আবারো এ দোয়া চাই, যে গুরুদায়ীত্ব রাব্বুল আলামিনের কৃপায় আমি পেয়েছি তা পালনের সাধ্য যেন তিনিইি আমাকে দেন, জীবনের ভুলগুলো যেন শুধরে নিতে পারি, হিংসুকদের হিংসা থেকে যেন মুক্তি পেতে পারি, মানুষের কল্যানে, দেশের কল্যানে, অযুত সম্ভাবনার বাংলাদেশের একজন সেবক হিসাবে নিজেকে যেন নিয়োজিত করতে পারি। পরম করুনাময় আমাদের সকলের সহায় হোন।

 লেখা- এইডিশোনাল ডিআইজি মোঃ মনিরুজ্জামান এর ফেসবুক থেকে সংগ্রহ 




আপনার মূল্যবান মতামত দিন: