"রাজা সীতারাম ও আমাদের মাগুরা"

রাশেদ রেজা মাগুরা থেকে... | প্রকাশিত: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৩:০৭

রাশেদ রেজা মাগুরা থেকে...
প্রকাশিত: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৩:০৭

ছবি- সমসাময়িক ফটো।

কে এই রাজা সীতারাম রায়, কেনই বা জগত বিখ্যাত মাগুরার মহম্মাদপুর উপজেলা রাজবাড়িটি!

আসুন প্রথমেই জেনে নেই সীতারাম রায় কে ছিলেন, রাজা সিতারাম রায় উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থ ঘরের চিত্র গুপ্তের পুত্র। বিশ্বভানুর বংশে জাত কাস্যপদাস বংশীয় রাজা সিতারাম রায়, তৎকালীন উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থের মধ্যে বাৎসসিংহ সৌকালীন ঘোষ, বিশ্বমিত্র, মৌদগল্য দাস ও কাস্যপ দেবদত্ত আদি সুরের সময় এই বঙ্গে (বর্তমান বাংলাদেশে) আসেন।

ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে রাজা মানসিংহ যখন রাজ মহলে রাজধানী স্থাপন করেন, সম্ভবতঃ তখন শ্রীরাম দাস তাঁর নিকট হতে ‘‘খাস বিশ্বাস’’ উপাধী লাভ করেন। তিনি সুবাদারের খাস সেরেস্তায় হিসাব বিভাগে বিশ্বস্ত কর্মচারী ছিলেন। তৎপুত্র হরিশচন্দ্র অল্পবয়সে পিতার সঙ্গে রাজ সরকারে কার্যারম্ভ করেন এবং রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার সঙ্গে ঢাকায় যান ১৬০৯ খ্রীষ্টাব্দে। তিনি সেখানে কর্মদক্ষতা গুনে ‘‘রায় বাঁয়া’' খেতাব অর্জন করেন। তৎপুত্র উদয় নারায়ণ ভূষণার ফৌজদারের অধীন সাজোয়াল বা তহশিলদার নিযুক্ত হয়ে ভূষণায় আসেন তিনিই মূলত সীতারামের পিতা। মাগুরা জেলা শহর হতে ১০ মাইল পূর্বে মধুমতি নদীর তীরে মাগুরা জেলায় অবস্থিত মহম্মদপুর উপজেলা। এই মহম্মদপুর উপজেলা শহর এলাকায় ছিল রাজা সীতারামের রাজধানী ও নিজ বাসভবন, যেটা বৃহত্তর যশোরের তথা আজকের বাংলাদেশের গৌরবের স্থান। এদিকে ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত বোয়ালমারি উপজেলা শহর থেকেও এই স্থানে সহজে যাতায়াত করা যায়। বোয়ালমারী বাজার হতে ঐ স্থানটি ৬/৭ মাইল পশ্চিমে।

আমাদের বাংলা সাহিত্যের সম্রাট বঙ্গিম চন্দ্রের চট্টপাধ্যয়ের ‘‘সিতারাম’’ নামক উপন্যাসের কারনে জগৎময় পরিচিত। রাজা সিতারাম রায়ের রাজধানী ছিল মহম্মদপুরে, সীতারামের আদিনিবাস ছিলো অবিভক্ত ভারত উপমহাদেশের বীরভূম জেলায়, তাঁর পিতা উদয় নারায়ণ প্রথমে রাজমহলে নবাব সরকারের কর্মচারী ছিলেন, পরে ভূষণা পরগণায় তহশিলদার পদে নিযুক্ত হইয়া আসেন, তার পত্নীর নাম দয়াময়ী।
১৬৫৮ খ্রীষ্টাব্দে সীতারামের জন্ম হয়। উদয়ন নারায়ন ক্রমে একটি ক্ষুদ্র তালুক ক্রয় করেন এবং মধুমতি নদীর অপর পারে হরিহর নগর নামক স্থানে বসবাস করতেন।
ইতিহাস বলে সীতারাম রাজার মাতা দয়াময়ী তেজস্বিনী নারী ছিলেন, অল্প বয়সে একটি খড়েগর সাহায্যে এক দল ডাকাতকে তিনি পরাস্থ করিয়াছিলেন যে কারণে মহম্মদপুরে আজও ‘‘দয়াময়ী’’ তলা নামে একটি স্থান আজো স্মৃতি ধারণ করে আছে আর এই স্থানে সীতারামের সময়ে বারোয়ারী উৎসব হইতো। বিভিন্ন ইতিহাসবিদরা উল্লেখ্য করেন সীতারামের অভুত্থান সর্ম্পকে নানারূপ, কেহ কেহ বলেন যে সপ্তদশ শতকের শেষভাগে বাংলার তদানিন্তন ভৌমিক রাজগণ যথাসময়ে রাজকর না দেওয়ায় দিল্লীর বাদশাহ সীতারামকে তাঁহাদের নিকট হইতে বাকী রাজকর আদায়ের জন্য সৈন্য সামন্তসহ প্রেরণ করেন। সীতারাম আসিয়া তাদের কে যুদ্ধে পরাস্ত ও রাজ্যচ্যুত করিয়া স্বয়ং তাহাদের রাজ্য অধিকার করেন এবং পরে বাদশাহের সহিত বিবাদের ফলে মূলত তার পতন হয়।
বর্তমান মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলার কাছাকাছি শ্যামনগর গ্রামেও তাঁহার কিছু ভু-সম্পত্তি ছিল। এদিকে প্রবাদে আছে, মহম্মদ শাহ নামক স্থানীয় এক ফকিরের নাম হইতে মহম্মদপুর নামের উৎপত্তি হয়। রাজা সীতারামের প্রভাবে সমগ্র ভুষণা তাঁহার অধিকারভুক্ত হয় এবং দস্যু সরদার রাজার সহিত যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে রাজা সিতারামের সেনাবাহিনীতে যোগদান করে। ১৬৬২ সালের গোড়ার দিকে রাজা সীতারাম রায় স্বাধীন রাজার মত রাজ্য পরিচালনা করতেন। কিন্তু দ্রুতই ভূষণার ফৌজদার মীর আবু তোরাপের সাথে রাজা সিতারামেে সংঘর্ষ হইলো। আর এ যুদ্ধে সীতারামের সেনাপতি মেনাহাতির হস্তে আবু তোরাপ নিহত হয়।
মেনাহাতীর প্রকৃত নাম রামরূপ ঘোষ, তিনি রাজা সিতারামের প্রধান ভরসা, দক্ষিণ রাঢ়ীয় কায়স্থ ছিলেন মেনাহাতী। মেনাহাতী মানুষ হইলেও একটি ছোটখাট হাতী মত ছিলেন, নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ মেনাহাতী ও সীতারামকে দমন করার জন্য বক্স আলী খাঁ ও দিঘাপতিয়ার দয়ারাম রায়ের নেতৃত্বে বহু সৈন্য-সামন্ত দিয়ে যুদ্ধ করে রাজা সিতারাম রায় কে পরাস্থ করেন। কথিত আছে যে, মেনাহাতীর মস্তক কেটে মুর্শিদাবাদে পাঠানো হয় এবং পরে মৃতদেহ ও মস্তকটি মহম্মদপুরে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। মূলত মেনাহাতীর মৃত্যুর পর সীতারামের পতন ঘটে, যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দি হয়ে রাজাকে মুর্শিদাবাদে নেওয়া হয়। পরে নাটোরের রাজবাড়ি কারাগারে বন্দি করে রেখে কয়েক মাস বন্দী থাকার পর মুর্শিদাবাদে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয় তবে কেহ কেহ বলেন, তিনি বিষ পানে আত্মহত্যা করেন। মুর্শিদাবাদে গঙ্গাতীরে তাঁহার শ্রাদ্ধ হয়েছিল।

মাগুরার মহম্মদপুরে সীতারামের বহু কীর্তি আজ ও বিদ্যমান। যেমন, প্রাচীন দুর্গের ধ্বংসাবশেষ, রাম সাগর, সুখ সাগর ও কৃষ্ণসাগর নামে দীঘি, দোল মঞ্চ ও রাজভবনের ধ্বংসাবশেষ সিংহদরওজা, মালখানা, তোষাখানা, দশভুজা মন্দির, লক্ষ্মী নারায়ণের অষ্টকোন মন্দির, কৃষ্ণজীর মন্দির প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। অতীতে এই দুর্গের চর্তুদ্দিকস্থ খাত দিয়ে মধুমতির স্রোত প্রবাহিত হতো। সীতারামের দুইটি প্রধান বড় কামানের নামকরণ হইয়াছিল কালে খাঁ ও ঝুম ঝুম খাঁ। রামসাগর দীঘিটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৫০০ ফুট ও প্রস্থে ৬০০ ফুট। রামসাগরের জল এখনও প্রায় নির্ম্মল ব্যবহারোপযোগী আছে। কৃষ্ণসাগর দিঘীটি মহম্মদপুর দুর্গের দক্ষিণ পূর্ব দিকে কানাই নগর গ্রামে অবস্থিত।
রাজা সীতারাম রায়ের পতনের পর ভূষণা রাজ্য নাটোর রাজ বংশের সম্পত্তিতে পরিনত হয়।
১৮৩৬ খ্রীষ্টাব্দে এক ভীষণ মহামারীর ফলে মহম্মদপুর একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে যায়, এবং তারপর ক্রমশঃ ইহা একটি নগন্য পন্ডগ্রামে পরিনত হয়। বাগেরহাট জেলার খাঁন জাহান আলী মতো সীতারামেরও একদল বেলদার সৈন্য ছিল। কথিত আছে, সংখ্যায় এরা ২২০০ ছিল এবং যুদ্ধের সময় ছাড়া অন্য সময়ে জলাশয় খনন করে লোকের জলকষ্ট দুর করাই তাহাদের কাজ ছিল। কথিত আছে, সীতারাম প্রতিদিন নবখনিত জলাশয়ের জলে স্নান করিতেন এবং এই জন্য প্রতিদিন রাজ্যের বিভিন্ন স্থান হইতে রাজধানীতে জল আনা হইতো। এইরূপে তিনি বহু পুস্করিণী প্রতিষ্টা করে গেছেন।
সীতারামের সৈন্যদলে বহু মুসলমান ছিলেন। কথিত আছে, তিনি মুসলমান সেনাপতিদের ভাই বলে ডাকতেন এবং হিন্দু মুসলমানের মিলনের জন্য সতত চেষ্টিত ছিলেন। গ্রাম্য কবিদের গানে ও গাঁথায় এর প্রমাণ আজও পাওয়া যায়।

ভ্রমণ পিপাসুরা কিভাবে যাবেন রাজা সিতারামের রাজবাড়িতেঃ মাগুরা সদর হতে ২৮ কি.মি. দূরে মহম্মদপুর উপজেলায় রাজাবাড়ী নামক স্থানে রাজা সীতারাম রায়ের বাড়িটি অবস্থিত। মহম্মদপুর বাস স্ট্যান্ড হতে আধা কিলোমিটার উত্তরে পাকা রাস্তার পার্শ্বে রাজবাড়ির অবস্থান। রিক্সা, ভ্যান অথবা পায়ে হেটে যাতায়াত করতে পারেন।




আপনার মূল্যবান মতামত দিন: