কবি ও সাহিত্যিক আশরাফ হায়দার এর লেখা ছোট গল্প- "সম্পর্ক"

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ১০ মার্চ ২০২১ ১৩:০৭

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০ মার্চ ২০২১ ১৩:০৭

ছবি সমসাময়িক
   

আশরাফ হায়দার।।

বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। বাঙালি জাতির সব চেয়ে বেশি আনন্দের দিন। ত্রিশ লাখ শহিদের  আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া প্রাণের স্বাধীনতা। সেই মাস হলো মহান বিজয়ের মাস। অার কয়েকদিন বাদেই মহান বিজয় দিবস। শহরে বিজয় দিবসের অাগমনী সুর বাজতে শুরু করেছে। স্কুল,কলেজে রব রব সাজ। বিভিন্ন স্থানে বিজয়ের মেলা বসবে। মিষ্টিমিষ্টি সোনালী রোদ। ভোরের কুয়াশা আছন্ন ভোর। শিশিরে শিশিরে জড়ানো ভোরে ঝরে পড়া শিউলী ফুলের ঠোঁট।   সকাল এগারোটা বাজে প্রতিদিনের ন্যায় অাজও সাজিত হাজির হলো সিকদারের বইয়ের দোকানে। সিকদার হলো সাজিতের বন্ধু। বই কিনতে কিনতে হয়ে গেল বন্ধুত্ব। বেশ কয়েক বছর ধরে সিকদারের দোকান হতে সাজিত বই কেনে। এখানে ভাল ভাল তথ্যের বই পাওয়া যায়। বিশেষ করে নজরুল, রবীন্দ্রনাথ,জীবনানন্দ দাস, তারপর ভারববর্ষের স্বাধীনতার ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বই।   প্রতিদিনের মতো অাজও সাজিত গেল সিকদারের দোকানে। কথা বলছে দুই বন্ধু প্রাণ খুলে। মাঝে মাঝে অট্টহাসি দিচ্ছে। এমন সময় একজন ভদ্র মহিলা এসে হাজির হলেন। সিকদার কথা থামিয়ে দাঁড়িয়ে সালাম ঠুকিয়ে দিল। তারপর সাজিতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। কবি সাজিত। অামার ভাল একজন বন্ধু। ডক্টর তাহমিনা। সাজিত ও তাহমিনার মধ্যে সৌজন্য সালাম ঠুকাঠুকি হলো। তাহমিনা বললেন, অাপনি লিখেন? কি লেখেন? সিকদার বললো, অাপা ভাল কবিতা, গল্প ও ফিউচার লেখে। জনকণ্ঠে প্রায় লেখা ছাপা হয়। সাজিত কথা না বাড়িয়ে বললো, তেমন কিছু নয়। মাঝেমাঝে একটু অাধটু লিখি বৈকি।   তাহমিনা বেশ কিছু নজরুল বিষয়ক বই নিলেন। তখন সাজিতের বুঝতে অার বাকি রইলো না। এনি ভাল একজন সাহিত্যিক বটে। নজরুল সাহিত্য নিয়ে হয়তো গবেষণা করছেন।  সাজিত তাহমিনাকে বললো,অাপনি লেখালেখি করেন। তাহমিনা বললেন, না। অার কোন কথা হলোনা। সাজিত তাকিয়ে অাছে তাহমিনার দিকে। সাজিত এমন ভাবে তাকিয়ে অাছে যেন জীবনে কোনদিন কোন মেয়ে মানুষ দেখিনি। মাথা থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত নিখুঁতভাবে তন্নতন্ন করে দেখছে। তাহমিনার পরনে ছিল একটি গোলাপি রঙের জামদানি শাড়ি। শাড়িটি খুব দামি হবে। তাহমিনা হয়তো একটু অাচ করে ছিলেন। তাই সাজিতকে বললেন, অারে কবি সাহেব এমন ভাবে ভাবলে হবে। অারো গভীরে যেতে হবে। সাজিতের দুটি মাংস পিন্ড লন্ডভন্ড। সাজিত কোন কথা বললো না। তাহমিনা বইয়ের টাকা পরিশোধ করে চলে যাবার সময় সাজিতকে আস্তে করে বলে গেলেন, অামাকে নিয়ে একটি কবিতা লিখবেন। সাজিত কোন কথা না বলে চলে যাবার পদধ্বনি শুনতে ছিল। পায়ে খুব সম্ভব নুপুর বাঁধা ছিল। তাই চলার সাথে সাথে নুপুরের শব্দ বাজতে ছিল। সাজিতের চোখের গভীরতায় ভেসে এলো তাহমিনার কারুকার্যময় মুখখানা। পুরা শরীর যেন কারুকার্যময়। গায়ের রঙ কাঁচা হলুদের মত টকটক করছে।   এমন সময় কয়েকটি মেয়ে কলেজ ড্রেসপরা অবস্থায় দোকানে ঢুকলো এবং বললো, হায়,হায় ম্যাম এসে ছিল। তখন সাজিত মেয়েদের কাছে জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কোন কলেজে পড়? মেয়ে গুলো কলেজের নাম বললো। সাজিত বললো তোমাদের শিক্ষক বুঝি? মেয়েরা বললো, অামাদের বাংলার ম্যাম। খুব ভাল পড়ান। সাজিত অার কোন কথা না বলে সিকদারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।   কবি, লেখক,তৈলশিল্পীদের যা খাঁজলোত তাই। মেয়ে মানুষ দেখলে তো অার হুস থাকেনা। তার নাক,মুখ,চোখ, চুল,দাঁত, সব খুঁটিয়ে,খুঁটিয়ে দেখে তারপর কেউ তার ছবি অাঁকে অাবার কেউ তাকে নিয়ে নিজের মত করে সাহিত্য রস দিয়ে কাব্য লিখে। সাজিতের বেলায়ও তাই হলো। সাজিত কোন নামিদামি কবি নন। তারপরও তাহমিনাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করলো। যেমন কথা তেমনি কাজ। স্মৃতির পাতায় কবিতার কয়েকটি লাইন নোট করা হয়ে গেল। যাকে বলে অলিখিত সংবিধান।   সিকদারের বইয়ের দোকানের কয়েক গজ দূরে নিলময় চশমার দোকান। সাজিতের বন্ধু শাসসুল হক সেই দোকানে চাকরি করেন। শামসুলের কাছ থেকে প্যাডের পাতা অার কলম নিয়ে কবিতা লিখা শুরু করলো। অবশ্যই শামসুল হক লেখার জন্য সহ-যোগিতা করলো। কবিতার নাম  "সম্পর্ক"। কবিতার প্রথম লাইন হলো, "নববর্ষার ভরা নদীর মেয়ে তুমি, তোমার সর্বাঙ্গে জড়ানো কৃষকের উর্বর পলি"। কবিতাটি লিখতে প্রায় দু'ঘন্টা সময় লাগলো। লেখা শেষ করে শাসছুল হককে কবিতাটি পড়ে শুনালো। শাসছুল হক হতবাক! চমৎকার পদ্য। যেমনই ছন্দ,তেমনই শব্দচয়ন। প্রতিটি লাইনে  কাব্যরস ভরা। ছন্দের মালা গাঁথাুনি। রোমান্টিক কাব্য। এক কথায় বলা যায় অনবদ্য।   শাসছুল হক বললো, বন্ধু তুমি কাকে নিয়ে এই কবিতাটি লিখলে? সে কিন্তু তোমার প্রেমে পড়ে যাবে। চশমার দোকানের সবাই হেসে উঠলো। এমনকি এক মহিলা তো বলেই ফেললেন, অারে শাসছুল ভাই অামি তো প্রেমে পড়েই গেছি। অাবারও হাসির বন্যা বয়ে গেল। এই মহিলা হলেন শাসছুল হকের বন্ধু। এক সাথে রেডিওতে নাটক করেন। সাজিত বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।   সেদিন ছিল মঙ্গলবার। সাজিতের দুপুরে অার খাওয়া হলোনা। সাজিত সোজা চলে গেলো জনকণ্ঠ অফিসে। তখন সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন কবি নাসির অাহমেদ। নাসির সাহেব সাজিতকে খুবই স্নেহ করতেন। সাজিত নাসির সাহেবকে কবিতা দিয়ে বেরিয়ে পড়লো বাসার উদ্দেশ্যে। ক্ষুধায় পেটমাহাজন চো-চো করছে। তখন পাঁচটা বাজে। এখন তো বাসায় গেলে খাবার পাবেনা। কবি সাহিত্যিকের যা কাজ তাই। হোটেলে গিয়ে গরম গরম দু'টি সিঙ্গাড়া অার এককাপ দুধের চা খেয়ে নিল। বাঃ এবেলা শেষ।   সাজিতের মাথায় এখন বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে কেন কবিতা লিখতে বললো? তিনি কি বিবাহিত? কবিতা পেপারে ছাপা হলে তিনি করি ভাববেন? কারন কবিতায় তার নাম অাছে। মাথায় এখন হাজারও প্রশ্ন।   সন্ধ্যায় বেইলী রোডে বন্ধু কবি অনামিকার সাথে বেশ অাড্ডা দিল। ওই দিন গাইড হাউজে নাটক ছিল "রক্ত করবী "। পাসও ছিল দুটি। অার কি সাজিত অার অনামিকার দেখার পালা। দুই টাকা দিয়ে বাদাম কিনে নিয়ে হলে গিয়ে বসলো। খালেদ খান অার অপি করিম অভিনীত নাটক। কি চমৎকার দু'জনের অভিনয়। অাসলে তারা দু'জনই শক্তিধর অভিনেতা। নাটক দেখা শেষ করে বাসার যাবে। রাত বাজে দশটা। অনামিকা বায়না ধরলো তাকে বাসায় পৌঁছে দিতে হবে। অার কি যথা হুকুম তামিল। পৌঁছে দিতে গেলো। পৌঁছে দিয়ে সাজিত বাসায় ফিরলো রাত বারটাই।   শক্রবার কবিতাটি জনকণ্ঠ পেপারে ছাপা হলো। সাজিত তো ভীষন খুশি। খুশি হবারই কথা। জনকণ্ঠ পত্রিকা বলে কথা। হাজার হাজার মানুষ কবিতাটি পড়বে এটা কি কম কথা। তারপর অাবার সম্মানী চেক পাবে। সাজিত শক্রবার সকালে কবিতাটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে লাগলো।   সেদিন চলে গেলো। পরের দিন অর্থাৎ শনিবার সাজিত সিকদারের বইয়ের দোকানে গেল। সাজিতের যাবার অাগে তাহমিনা সিকদারকে বলে এসেছেন, অাপনার কবি বন্ধুকে বলবেন,খেটে খাওয়া মানুষদের নিয়ে কবিতা লিখতে। সিকদার তো অবাক! সে কবিতার বিষয়ে কিছুই জানেনা। তাহমিনাকে কি-যে বলবে তা ভেবে পাচ্ছেনা। রাগে গড়গড় করতে করতে তাহমিনা বেরিয়ে গেলেন। সিকদার বুঝতে পারলো না এটা কি অভিমানের রাগ নাকি অন্য কিছু। সিকদার যখন সাজিতকে বললো,তখন সাজিতও অবাক হলো। সাজিত সিকদারকে সব খুলে বললো। সিকদারের বুঝতে অার বাকি রইলো না। দুই বন্ধুর মধ্যে অনেক কথা বার্তা হলো। বিশেষ করে নেতাজি সুভাষ  চন্দ্র বসু অার বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। দুই শ্রেষ্ঠ বাঙালির জীবন আদর্শ নিয়ে বেশ গবেষণা মূলক অালাপ হলো। এই অালোচনার মধ্যে অনেক তথ্য বেরিযে এলো। অাজকের মত অালোচনা শেষ করে সাজিত বেরিয়ে পড়লো।   দুমাস পরে হঠাৎ বৃষ্টির মত বই মেলায় সংঘ প্রকাশনে তাহমিনার সাথে দেখা হয় সাজিতের। সাজিত চিন্তে পারিনি তাহমিনাকে অার তাহমিনাও কোন প্রকার পরিচয় দিলেন না। সাজিত খুবই পিড়াপিড়ি করলো তাতে কোন কাজ হলো না। হাজার হলেও একজন অধ্যাপিকা বলে কথা। যাবার বেলায় একটা অন্যরকম হাসি দিয়ে তাহমিনা বলে গেলেন দেখা হবে কোন একদিন। এই হাসির মাঝে কোন একটা ইঙ্গিত ছিল। সাজিত চিন্তায় পড়ে গেল। কোথায় যেন দেখেছে তাকে। কেন মনে পড়ছেনা। স্মৃতি কেন এত বিধুর হচ্ছে! মনের মাঝে যেন কালবৈশাখি ঝড় বয়ে যাচ্ছে।   সাজিত জনকণ্ঠে প্রতিদিন একবার করে যায়। কবি নাসির অাহমেদ'র সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ ভাবে সময় কাটে। সাহিত্য বিষয় নিয়ে গল্প গুজব হয়। প্রতিদিনের মত সাজিত অাজও জনকণ্ঠে গিয়েছে। রিসিভ সনে বসে অাছে। এমন সময় দেখে গতকালের সেই মহিলাটি। সাজিতকে দেখে অাজও তাহমিনা একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, কেমন অাছেন? সাজিত উত্তর দিল বটে কিন্তু অাজও চিন্তে পারলো না।   তাহমিনা রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াল। তখন সাজিতের একটি নাম মনে পড়লো। অার কি সাজিত তাহমিনা লিখে কাগজটি দেখাল। তাহমিনা হাসি দিল। তখন সাজিত বুঝতে পারলো সেই কবিতার তাহমিনা।   তাহমিনা সাজিতকে বললেন, যদি কাজ না থাকে তাহলে চলুন কফি খাওয়া যাক। দু'জনে হাঁটতে হাঁটতে চলে অাসলো মগবাজার মোড়ে। থ্রিস্টার হোটেলে বসে পরিচয় পর্ব শুরু হলো। এরই মাঝে কফির অর্ডার হয়ে গেছে। কফি খেতে খেতে তাহমিনা বললেন, অামি অাপনাকে কবি বানাবো। সাজিত বললো, কেন? উত্তরে তাহমিনা বললেন, ভাল লাগে তাই।   তাহমিনার এক ছেলে, এক মেয়ে। তারা রাজধানীর নামি-দামি স্কুলে পড়াশুনা করে। স্বামী ব্যারিস্টার। তখন বিকাল চারটা বাজে। এরই মধ্যে দুজনের মন দেওয়া নেওয়া হযে গেছে। দুজনের দু'টি মাংশ পিন্ড ছিল প্রেমের ব্যাকুলতা। সে এক অন্যরকম অাকুতি। শুরু হলো অমর প্রেম। ধরা যায় রাধা কৃষ্ণের মত প্রেম।   এ প্রেম সে প্রেম নয়। প্রতিদিন দুজনের ফোনে কথা হয়। একে অপারে ফোনে ব্যাকুল হয়ে উঠল কিন্ত কোনদিন তারা দেখা করেনা। পাশা পাশি তারা থাকে অথচ দেখা করেনা। যা কথা হয় ফোনে। কেবল কথা হয় সাহিত্য নিয়ে,দেশ নিয়ে, দেশের খেটে খাওয়া মানুষদের নিয়ে। প্রেম ভালবাসা নিয়ে। এমন ভাবে কথা হয় যেন তারা স্বামী স্ত্রী। কিন্ত না তারা পরম বন্ধু। আত্মার আত্মা। পরমাত্মা। যাকে বলে অমরত্ব বন্ধুত্ব।   সাজিত একের পর এক তাহমিনাকে নিয়ে কবিতা লিখতে লাগলো। তাহমিনাও খুশি। তাদের দুজনের এই প্রেমকে কখনও পরকিয়া প্রেম বলা যায় না। এ প্রেম সে প্রেম নয়। এ প্রেমে কোন চাহিদা নেই। নেই কোন শারিরিক ভাবে চাওয়া পাওয়া। এ প্রেমে অাছে পবিত্র ভালবাসার বন্ধন। কেবল অমর প্রেমে দু'জন তারার মালা গেঁথে রেখেছে।   এভাবে চলছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অার বছরের পর বছর প্রেম ভালবাসার মালা গাঁথা। অথচ কেউ কারো সাথে দেখা করেনা অার অাজও তারা দেখা করিনি। অথচ তারা দুজন পরম বন্ধু। এই বন্ধুত্বের মধ্যে কোন খ্যাত নেই।   এরই মধ্যে বাইশ বছর কেটে গেল। কেটে গেল দু'জনের জীবনে বাইশটি বসন্ত। তাহমিনার চুল পাক ধরেছে। নানি,দাদি হয়েছে। সাজিতও বিয়ে করে সুখে শান্তিতে অাছে। এখনও দু'জনের ফোনে কথা হয়,অার কথা হবেও কারন দু'জনের বন্ধুত্ব যে অমর প্রেমে চিরদিন, চিরকাল তারার মালা গাঁথা।   প্রেম ভালবাসার সেই সম্পর্ক এখনও যে দু'টি হৃদয়ে বিদ্ধমান। থাকবে অনন্তকাল। সাজিতও ভুলতে পারিনি অার তাহমিনাও ভুলতে পারিনি। দু'জনের জীবন কেবল ছন্দে ছন্দে গাঁথা, গানের সুরে সুরে বাঁধা। সাজিত অার তাহমিনার সম্পর্ক পৃথিবীর বুকে অমর হয় রইলো।


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: