কবি শহিদুজ্জামান মিলনের ছোটগল্প "কৃষক ও তার সাদা গাভী" 

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ২১ অক্টোবর ২০২০ ১২:৩৯

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২১ অক্টোবর ২০২০ ১২:৩৯

ছবি সমসাময়িক
[gallery ids="835"]
কৃষক ও তার সাদা গাভী
শহিদুজ্জামান মিল
এক গ্রামে এক কৃষক বাস করতো।স্ত্রী আর দুই ছেলেকে নিয়ে কৃষকের ছিলো সুখের সংসার।তার একটা সাদা গাভী আর বাড়ির পাশেই এক খন্ড জমি জমি ছিলো।কৃষক জমিতে ঘাষ লাগাতো আর সেই ঘাস কেটে কেটে তার গাভীকে খাওয়াতো।গাভীটি প্রতিদিন পাঁচ কেজি করে দুধ দিতো। কৃষক কিছু দুধ তার দুই ছেলের জন্য রাখতো অবশিষ্ট দুধ হাটে বিক্রি করে দিতো।প্রতিদিন সকালে সে নিজে হাতে গাভীটি দোহন করতো তারপর দুধ নিয়ে চলে যেতো  পাশের হাটে, দুধ বিক্রি করে যা পেতো চাল ডাল তরকারি মাছ কিনে বাড়ি ফিরতো।কৃষক বাড়ি ফিরলেই তার বউ রান্নার জন্য  রান্না ঘরে ঢুকতো।এদিকে কৃষক স্নান সেরে গাভীটিকে গোয়ালে দিয়ে খাবার দিতো।তারপর দুইপুত্র স্ত্রীসহ এক সাথে বসে দুপুরের খাবার খেতো।বিকাল বেলা কৃষক তার গাভীটি নিয়ে পাশের খোলা মাঠে ছেড়ে দিতো, সন্ধ্যায় বাড়ি এনে গোয়ালে তুলে দিতো।রাতে ঘুমানোর আগে কয়েক বার খাবার দিতো নান্দায়।গাভীটির গায়ের রঙ ছিলো সাদা,কৃষক আদর করে তার নাম দিয়েছিল ধলা।
এভাবে খুব ভালো চলছিলো কৃষকের।কৃষক মাঝে মাঝে ভাবে তার গাভীটি কতই না ভালো,গাভীর বদৌলতে সংসারে এখন কোনো অভাব নেই।তার এসুখ বেশি দিন সইলো না।হঠাৎ করে কৃষকের স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লো।কিছুই খেতে পারে না।ক্রমস দুর্বল হতে লাগলো।পাশের গ্রামের বড় কবিরাজ ডেকে আনা হলো। কবিরাজ হাত ধরে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করলো,তার পর ঝাড়ফুঁক করলো, গাছগাছালি দিয়ে তৈরি এক বোঝা ঔষধ দিয়ে গেলো।ঔষধ খায় কিন্তু কৃষকের স্ত্রীর কোন পরিবর্তন হয় না।দিনদিন আরো খারাপের দিকে যায়।কৃষকের কপালের ভাঁজ গাঢ় হতে লাগলো।ভেবেই পায় না কি করবে এখন।শহরে নাকি বড় ডাক্তার আছে, সেখানে টাকাও লাগে অনেক।এত টাকা তো তার নাই।
এদিকে কৃষকের স্ত্রীর শরীর শুকাতে শুরু করলো।পানি ছাড়া কিছুই খেতে পারে না।মাঝে মাঝে বমি হয়।কৃষক ভেবে কূল পায় না কি করবে।অবশেষে সিদ্ধান্ত  নিলো গাভীটি বিক্রি করবে।সেই টাকা দিয়ে স্ত্রীকে চিকিৎসা করাবে।সারারাত তার ঘুম হলো না।গাভী বিক্রি করলে সংসার চলবে কেমনে?গাভী থাকলে নিজেরা খেতে পারবে, গাভী বিক্রি করলে সবাই না খেয়ে মরতে হবে। তাই মত পাল্টে ঘাস লাগানো তার সেই একখন্ড জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিলো।চিন্তা করলো নিজের পেটে খাবার থাকলে গাভীর খাবার সে জোগাড় করতে পারবে।গ্রামের সবচেয়ে ধনী লোক কাশেম দফাদারের কাছে গেলো এবং তার সকল কথা বলে জমি বিক্রির ইচ্ছার কথা জানালো।কাশেম দফাদার জমি কিনে নিতে রাজি হলো।সেই দিনই তার জমির সব টাকা পরিশোধ করে দিলো।
কৃষক পরদিনই খুব ভোরে স্ত্রীকে নিয়ে ভালো ডাক্তার দেখাতে শহরে গেলো।হাসপাতালে যেয়ে টিকিট করলো, ডাক্তার দেখে কিছু পরিক্ষা নিরিক্ষা করতে বললেন।কৃষক সব পরিক্ষা নিরিক্ষা করিয়ে রিপোর্ট পেতে বিকাল হয়ে গেলো।তারপর ডাক্তারের কাছে রিপোর্ট দেখাতে গেলো। ডাক্তার তাকে অভয় দিলো ভয়ের কিছু নেই আর ঔষধ লিখে দিলো।তবে নিয়মিত ঔষধ খেতে হবে এবং পনের দিন পর অবশ্যই আসতে হবে।রুগীর অগ্রগতি ডাক্তার দেখবে আর ঔষধে কাজ না হলে ভর্তি রাখতে হবে কিছু দিন।
কৃষক ও তার স্ত্রী বাড়ি ফিরতে বেশ খানিকটা রাত হয়ে গেলো।বাড়ি ফিরেই স্নান সেরে দু -মুঠো ভাত খেয়েই বিছানায় কাত হলো।সারাদিনে প্রচন্ড ধকল গেছে তার উপর ক্লান্ত শরীর দ্রুত ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আসলো।মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে তার গাভীর কথা মনে পড়লো।সারা দিন কোন খবরই নিতে পারে নি।সেই সকালে রেব করে রেখে গেছে, যাওয়ার সময় বড় ছেলেকে বলেছিলো গাভীটাকে খাওয়াতে।দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে কৃষক গোয়ালের সামনে আসলো। দেখে তার গোয়াল ফাঁকা গাভী নেই,বাছুরটা বসে আছে গোয়ালের এক কোণে।গোয়লের দরজা ছিলো না ভাবলো হয়তো দঁড়ি খুলে গেছে আসে পাশে কোথাও আছে। ছেলেকে ডাকলো,
-বাজান উঠ তাড়াতাড়ি ধলা তো গোয়ালে নেই।
বাপের ডাকে কৃষকের চৌদ্দ বছরের কিশোর ছেলে উঠে পড়লো বিছানা ছেড়ে।
-বাবা আমি তো বিকেলে মাঠ থেকে এনে গোয়ালে বান্দে রাখছিলাম।
কৃষক দেখলো বাইরে খৈল ভিজানো নান্দায় পানি নাই। তখন ভাবলো নিশ্চয়ই ধলার দড়ি খুলে গেছে। গোয়াল থেকে বের হয়ে নান্দার সব পানি খেয়ে ফেলেছে।ভাবলো আশে পাশেই আছে।বাপ ছেলে মিলে আশে পাশে বন জঙ্গল সব দেখলো লাইট জ্বালিয়ে। কিন্তু ধলাকে পাওয়া গেলো না।
ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে আসলো। তখনই মসজিদ হতে ফজরের আযান ভেসে আসলো।কৃষক আবার খুজতে বের হলো।আশে পাশের গ্রামে সব জায়গায় খোঁজা হলো কোথাও ধলাকে আর পাওয়া গেলো না।কৃষক হতাশ হয়ে বসে রইল।
বারান্দায় অসুস্থ স্ত্রী শুয়ে।তখন অনেক খানিক বেলা হয়ে গেছে পাশের মোড়ল বাড়িতে হট্টগোলের শব্দ কানে আসতে কৃষক এগিয়ে গেলো মোড়ল বাড়ির দিকে।কারা যেনো জটলা পাকিয়ে কি সব বলাবলি করছে।কাছে যেতেই কৃষক যা দেখলো, নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না।কান্নায় ভেঙে পড়লো তার ধলা আর নেই।
মোড়ল বাড়ির সামনে বাড়ির পানি পুকুরে বের করার জন্য বড় নালা কাটা পাশেই কলাগাছ কিছু ঝোপঝাড়। ধলা হয়তো রাতে দড়ি খুলে গোয়াল থেকে বের হয়ে খেতে খেতে এদিকে এসেছিলো। পা পিছলে নালায় পড়ে আটকে গেছে। পেট টা ফুলে গেছে,ঘাড়টা মোচড়ে পড়ে আছে।দেখেই বোঝা যাচ্ছে উঠার অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু পারিনি।অবশেষে ধলা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে।
মোবাইলঃ০১৭৪৭৫০০২৭২



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: