শহীদ লেঃ আনোয়ার হোসেনের মৃত্যু বার্ষিকীঃ কিছু স্মৃতি কিছু কথা

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ২২ মার্চ ২০২২ ০৪:৩২

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২২ মার্চ ২০২২ ০৪:৩২

ছবি সমসাময়িক
নিউজ ডেস্ক।। শহীদ লেঃ আনোয়ার জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৪৭ সালের ৫ মে চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার আলী গঞ্জ সরকারী এতিমখানা কোয়ার্টারে। তার নানা মরহুম এয়াকুব আলী ছিলেন এতিম খানার সুপার। শহীদ আনোয়ারের পৈত্রিক নিবাস চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলার সোনাপুর গ্রামে। পিতা আব্দুল হক ছিলেন পুলিশ বিভাগের একজন কর্মকর্তা। সাত ভাই বোনে মধ্যে আনোয়ার ছিলেন পিতা মাতার দ্বিতীয় সন্তান। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন অফিসার পদে তিনি রিক্রট হন। এরপর পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক প্রশিক্ষণ একাডেমী কাকুল হতে চুড়ান্ত পরীক্ষায় সফল ভাবে উত্তীর্ণ হন এবং ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি সময়ে সেকেন্ড লেঃ হিসেবে যশোর সেনানিবাসে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করেন। ১৯৭১ সাল ৩০ মার্চের শেষ সপ্তাহে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা তখন যশোর চৌগাছা এলাকার জগদীশপুর এলাকায় গ্রীষ্মকালীন মহড়ায় ব্যস্ত ছিলেন। ঐ সময় তাদেরকে পাঠানো হলো সিগন্যাল ম্যাসেজ দ্রুত ব্যারাকে ফিরে আসার জন্য ফিরে আসার পর পরই তাদেরকে করা হলো নিরস্ত্র। তরুন অফিসার লেঃ আনোয়ারের তাজা খুন উঠলো টগবগিয়ে। জ্বালা ধরিয়ে দিলো তার অস্তিমমজ্জায়। তিনি ভাবলেন এভাবে নিরস্ত্র হয়ে শিয়াল কুকুরে মত মরার চেয়ে লড়াই করে বীরে মত শহীদ হওয়া গৌরবের কাজ। ১৯৭১ সাল ৩০ মার্চ সকাল পৌনে দশটা বাঙালী সৈন্যরা প্রথম বিদ্রোহ ঘোষনা করে যুদ্ধ শুরু করে পাক হানাদার সেনাবাহীর বিরুদ্ধে। হানাদার বাহিনী যেখানে ওদের নিরস্ত্র করে অস্ত্র জামা রেখেছিল একটি হাতুড়ি নিয়ে সেখানে ছুটে গেলেন লেঃ আনোয়ার তাকে অনুসরণ করলেন কয়েকজন বাঙালী সৈনিক। মুহুর্তের মধ্যে অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে হাল্কা অস্ত্র নিয়ে তারা এলেন বেরিয়ে। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে এই অস্ত্রবের হওয়ার খবর পৌছে গেল ওদের হাই কমান্ডে। একই সময়ে আরেকজন সহযোদ্ধা তরুন অফিসার লে: হাফিজ উদ্দীন ও অস্ত্র তুলেনেন হানাদারদের বিরুদ্ধে। একদিকে ভারী অস্ত্র অপরদিকেবিদ্রোহীদের হাতে সামন্য হাল্কা ধরনের অস্ত্র। তবুও বিদ্রোহী সেন্যরা প্রাপনে লড়ছিলেন হানাদারদের বিরুদ্ধে। হাঠাৎ একটি মেসিনগানের ব্রাশ ফায়ার এসে লেঃ আনোয়ারের তরপেট ও উরু ঝাঁঝরা করে দেয়। আহত অবস্থায় সঙ্গী সৈনিকের নিয়ে আসে সানতলা সেনানিবাসে পাশে ছাতিয়ানতলা গ্রামে। প্রচুর রক্তক্ষরণে তিনি শাহাদত বরণ করেন। পরে গ্রমের ৩ জন যুব ও সাথী সৈনিকেরা তার লাশ একটি গরুর গাড়ীতে করে (গরু বিহীন) নিজেরা গাড়ী টেনে কাজী নজরুল ইসলাম কলেজ সংলগ্ন হৈবতপুর গ্রামে আনা হয়। পরে স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে নামাজে জানাজা শেষে যশোর ঢাকা সড়কের ধারে একটি কড়ই গাছের ছায়ায় তাকে সমাহিত করা হয়। এখানেই ঘুমিয়ে আছেন চিরতরে বীর সৈনিক শহীদ লেঃ আনোয়ার। ১৯৭৩ হতে এই সুদীর্ঘ ৫১ বছরের স্মৃতি বিজড়িত ইতিহাস রয়েছে তা এই লেখার মধ্য দিয়ে আমি আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে চাই। ১৯৭৩ সাল। যশোর সেনানিবাসের তৎকালীন বিগ্রেড কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন লেঃ কর্নেল এম এ মঞ্জুর । তিনিই সর্ব প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন শহীদ লেঃ আনোয়ার হোসেনের মৃত্যু বার্ষিকী উদযাপন করার। ৩০ মার্চের কয়েকদিন পূর্বে যশোর সেনানিবাস কর্তৃপক্ষ থেকে আমাদের কলেজে খবরপাঠানো হয় আমাদের আামী ৩০ অনুষ্ঠেয় কর্মসূচীতে অংশ গ্রহণ করার। লেঃ আনোয়ার হোসেনের ২য় মৃত্যু বার্ষিকী সেবার পালিত হয়। সেই হতে অদ্যাবধি প্রায় ৫০ বছর যাত ধারাবাহিক ভাবে যথাযোগ্য মর্যাদার সহকারে শহীদের মৃত্যু বার্ষিকী উদযাপিত হয়ে আসছে। ১৯৭৩ সালের কথা। আমি তখন কাজী নজরুল ইসলাম ডিগ্রী কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি দৈনিক বাংলারবানী পত্রিকায় যশোর জেলা প্রতিনিধির দায়িত্বে ছিলাম। শহীদ লেঃ আনোয়ার হোসেনের মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপনের সংবাদটি ছবিসহ দৈনিক বাংলার বানী পত্রিকায় ছাপা হয়। উক্ত অনুষ্ঠানের সমস্ত আলোকচিত্র গ্রহণ করেন বিশিষ্ট আলোক চিত্র শিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা মোঃ শফি। আমার ও শফি ভায়ের সাথে লেঃ কর্ণেল এম এ মঞ্জুরের খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমি যতবার সেনানিবাসে এম এ মঞ্জুরের সাথে সাক্ষাত করেছি ততবারই আলোক চিত্র শিল্পী মোঃ শফি ভায়ের খোজখবর নিয়েছেন। যশোর সেনানিবাস হতে বদলী হওয়ার আগে তার সাথে সাক্ষাত করতে গেলে তিনি অধ্যক্ষ ও আমাকে বলেন আপনারা যে কোন সময় আমার কাছে আসবেন। আর লেঃ আনোয়ার এই অনুষ্ঠানকে সব সময় ধরে রাখবেন। এটি ছিল একজন সেনা কর্মকর্তা ও মুক্তিযোদ্ধার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন। আমরা আজও তার সেই অসিয়ত এখনও অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছি। এরপর লেঃ কর্নেল এম এ মঞ্জুর বদলী হন ঢাকা সেনা সদর দপ্তরে। ঢাকা গেলে সময় পেলেই তার সাথে সাক্ষাত করতে ভুলতাম না। উনি খুবই সমাদর করতেন। একবার অধ্যক্ষ ইব্রাহিম হোসেন ও আমি ঢাকা সেনানিবাসে স্টাফ রোডে বাসভবনে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য গিয়েছিলাম। তিনি আমাদের যে সম্মান ও অমায়িক আচরন করেছিলেন তা কোন দিন ভুলার নয়। সাক্ষাত পর্ব শেষে তিনি আমাদের নিজে গাড়ী চালিয়ে ঢাকার গন্তব্যস্থলে নামিয়ে দিয়ে যান। উনি তখন ব্রিগ্রেডিয়ার। এতবড় একজন উচ্চপদস্থ সেনা আফিসার হওয়া সত্বেও আমাদের প্রতি যে সম্মান দিয়েছিলেন তা চির স্মরনীয় থাকবে স্মৃতির মনি কোঠায়। আরেক বারের ঘটনা, এখনও আমার মনের চিরদিন দাগ কেটে আছে। এম এ মঞ্জুর তখন চট্রগ্রামের জিওসি ও মেজর জেনারেল। আমাদের কলেজে সৃষ্টি হয় একটি বড় সমস্যা। তখনই মনে পড়ে এম এ মঞ্জুরের যশোর থেকে বিদায় বেলার কথা। অধ্যক্ষ ও অমি সোজা ছুটে যাই চট্রগ্রাম সেনানিবাসে। তখন অপেক্ষাগারে নিজে এসে বললেন, আপনারা চা পান করুন। দরবার শেষে সব কথাই শুনবো। দরবার শেষে তার অফিস কক্ষে আমাদের মুখে বিস্তারিত সব কিছুই শুনলেন, খুবই ধৈর্য্যসহকারে বললেন, কলেজের সীল প্যাড এনেছেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বরাবর একটি আবেদন করতে। আবেদন পত্রটি উনার কাছে রেখে আমরা সোজা আবার যশোর ফিরে আসি। চট্রগ্রাম থেকে ফেরার এক সপ্তাহের মধ্যে হঠাৎ যশোর জেলা প্রশাসকের দপ্তরে রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে একটি চিঠি আসে আমাদের কলেজে রাষ্ট্রপতির অনুদান প্রাপ্তির চিঠি। রাষ্ট্রপতির এই অনুদান পাওয়ার পরই চারিদিকে সকল মহলে হৈ চৈ পড়ে যায়। এটা কি করে সম্ভব হলো? একবারে খোদ রাষ্ট্রপতির অনুদান। সত্যিকার বলতে গেলে বিঃ মেজর জেনারেল এম এ মঞ্জুর যদি যেদিন এই সহযোগীতা না করতেন তবে কলেজের সার্বিক উন্নয়নে অনেকটা বিঘিœত হতো। আমরা অনেক পিছিয়ে পড়তাম। এজন্যে মেজর জেনারেল এম এ মঞ্জুরের পাশাপাশি আরেক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের এই অবদানের কথা চিরদিন কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবো। তার কাছে আমরা চিরঋণী হয়ে থাকবো, এই অনুদান সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া জন্য। শহীদ লেঃ আনোয়ারের মৃত্যুবার্ষিকী পালনের ক্ষেত্রে আরেক জন সেনা অধিনায়কের কথা চির অম্লান থাকবে তিনি হচ্ছেন যশোর সেনানিবাসের সাবেক অধিনায়ক বিগ্রেডিয়ার মাশহুররুল হক। ৩০ মার্চ খুবভোরে ফজরের নামাজ শেষে যশোর সেনানিবাস হতে সোজা বলেআসতের মহীদের মাজার জেয়ারতের উদ্দেশ্যে এবং ঐদিন বিকেলে আয়োজিত কর্মসূচীতেও যোগদান করতেন। তিনি যশোর সেনানিবাসে যতদিন ছিলেন, অধ্যক্ষ ও আমাকে সেনানিবাসের বেশ কিছু অনুষ্ঠানে মেহমান হিসেবে উপস্থিত হওয়ার দাওয়াত দিয়েছেন। এপর তিনি বদলী হন পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে। ঢাকা সেগুনবাগিচায় তার দপ্তর ও ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে যখন সৌজন্য সাক্ষাত করেছি আমাদেরকে খুবই সমাদর করতেন। এরপর তিনি বদলী হন কাতারে বাংলাদেশস্থ দূতাবাসে । সুদূরে কাতার থেকেও তিনি আমাদের ভুলে যাননি। পত্র মারফত শহীদ লেঃ আনোয়ার হোসেনের অনুষ্ঠানটি ধরে রাখার তাগিদ দিয়েছেন বার বার। পরে তিনি কাতারেই প্রবাসে থাকাকালীন সময়ে ইন্তেকাল করেন। পরবর্তীকালে যশোর সেনানিবাসের যে সকল অধিনায়কও সাময়িক অফিসারগণ ৩০ মার্চ শহীদের মৃত্যু বার্ষিকীতে প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছেন তাদের কাথাও আমি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। এদের মধ্যে রয়েছেন ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলী, কর্ণেল এম নূরউদ্দীন, লেঃ কর্ণেল আব্দুল হাকিম মিয়া, কর্ণেল মহসীন উদ্দীন আহম্মেদ, মেজর কে এম আব্দুল ওয়াহেদ মেজর জেনারেল সাদিকুর রহমান, কর্ণেল সাদেক হুসাইন, মেজর জেনারেল মুস্তাফিজুর রহমান, কর্ণেল আব্দুল্লাহ, মেজর জেনারেল জামিল ডি. আহসান, মেজর জেনারেল কাজী আশফাক আহমেদ ব্রিগেডিয়ার এম হুসেইন সাদেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গোলাম মাওলা প্রমুখ। এছাড়াও লেঃ আনোয়ার হোসেনের আত্মীয় স্বজনরাও এসেছেন। এখন তাদের অনেকেই না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন্। শহীদ লেঃ আনোয়ার হোসেন রক্ত দিয়েছেন বলেই আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি। শহীদ লেঃ আনোয়ার হোসেনের মত নাম না জানা শত শহীদের রক্তের বিনিময়ে বহু স্বজন হারা মানুষের অশ্রুর বিনিময়ে বহু-মা-বোনদের ইজ্জতের বিনিময়ে পেয়েছি । অনেক ত্যাগ এবং রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা। আমাদের পূর্বপুরুষ যারা আমাদের স্বাধীনতার ফল ভোগ করে যেতে পারেনি তাদের অবদান আমরা বিস্মৃত হতে পারি না। স্বাধীনতা একটি জাতির অমূল্য সম্পদ, পবিত্র আমানত । আসুন আমরা এই দিনে সকলে দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ হই, স্বাধীনতা বিরুদ্ধ যে কোন ষড়যন্ত্র আমারা রুখবোই।
লেখক- অধ্যাপক মোঃ মসিউল আযম প্রবীন সাংবাদিক, কলাম লেখক ও উন্নয়ন কর্মী।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: