বাবার সাথে শেষ স্মৃতি কথা!

মোঃ শাহ্ জালাল।। | প্রকাশিত: ১১ মে ২০২২ ০৪:৩৭

মোঃ শাহ্ জালাল।।
প্রকাশিত: ১১ মে ২০২২ ০৪:৩৭

ঈদের নামাজ শেষে তোলা ছবি

বাবা, কেমন আছ তুমি? কোথায় আছ তুমি? শুনেছি মানুষ মারা গেলে তারা হয়ে যায় কিন্তু তুমি-ত তারা হওনি। যদি তারা হতে তবুও তোমায় দেখতে পেতাম কিন্তু তোমাকে-ত আমি দেখতে পাচ্ছিনা। বলতে পারিনা তোমার জন্য আমার বুকের গহীনটায় কেমন পুড়ে দিবারাত্রি। আচ্ছা, তুমি কি আমায় দেখতে পাও?

গত কয়েকটি দিন হলো অনেক আশা নিয়ে ঈদ করতে এসেছিলাম কর্মস্থাল ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি মণিরামপুরে।
ছোট বেলায় বাবা তুমি বলতে টাকার অভাবে নতুন জামা, নতুন পাঞ্জাবি, নতুন জুতা পরতে পারোনি। তাই তো বাবা সবসময় তোমাকে সন্তানের মতো করে বাজারের সেরাটা তোমার জন্য ক্রয় করতাম। এবারের ঈদেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি বাবা। নতুন জুতাটি হাতেনিয়ে বললে এতো টাকার দামী জুতা কেন কিনেছ এ'তো থেকে যাবে!! বাবা তুমি হয়তো বুঝতে পেরেছো তুমি আর এই পৃথিবীতে বেশি সময় নেই। তাই তোমার চলে যাওয়া পর বুঝতে পারলাম কথার সাথে কাজের অনেক মিল।

ঈদের আগের দিন সারাদিন আমি কোথাও যায়নি, এবং বাবাও আমাকে কোথাও যেতে দেয়নি। সকালে ঘুম থেকে উঠে গ্রাম ও বাজারের যেখানে যেখানে যেতে মনচাই সবখানেই বাবা তুমি বেড়িয়ে আসলে। সারাদিন আমার সাথে সাথে থাকলে কতো গল্প করলে কোথায় কি আছে কোথায় কি সমস্যা সবি জানিয়ে দিয়ে গেলে। ঈদের দিন সকালে গোসল সেরে নামাজ পড়তে গেলে আমার সাথে সেলফি তুললে। দুপুরে খাওয়ার পর আমাকে কোলে নিয়ে ঘুমালে এবং বার বার বলতে লাগলে বাবা'রা চিরকাল বেঁচে থাকে না। সত্যি তোমার দুপুরের কথা দিন শেষ হতে না হতেই সত্যিতে রুপান্তর করে সমস্ত পৃথিবীকেই বিদায় জানিয়েছ। সকল মায়াজাল ছিন্ন করেছ। আচ্ছা সত্যিই কি তুমি আমাকে মাকে তোমার আদরের মেয়েকে ছেড়ে যেতে চেয়েছিলে? মৃত্যুর আগ মুহুর্তে কি আমাদের চেহারা ভেসে উঠেছিল, তাই বার বার আমাকে ও তোমার রাজকন্যা কে ডাকছিলে? তুমি মারা যাবার আগে কি যেন বলতে চেয়েছিলে তোমার মেয়ের জামাই কে তা বুঝতে পারেনি। তখনও কি তুমি আমাদের নাম ধরে ডাকছিলে শেষ দেখা দেখার জন্য? মৃত্যু যন্ত্রনা কি খুব বেশি? খুব জানতে ইচ্ছা করে বাবা!!

তুমি সেদিন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলে তাই অনেক কিছুই দেখতে পাওনি।

তুমি দেখতে পাওনি তোমার জানাযার আগেই মায়ের পড়া শাড়ির সৌন্দর্যতা। জীবনে এই প্রথম দেখেছি তুমি হীন নিথর মাকে। হাতে চুড়ি নেই, কানে দুল নেই--এ যেন আমার মা নয়!!

বাবা, আজ তোমায় অনেক বেশি মনে পড়ছে। মনে পড়ছে পড়ালেখা রেখে খেলার জন্য যে মার দিতে, আদর করে যখন বাজান বলে ডাকতে, গোসল করিয়ে দিতে। সকাল বেলায় আমায় নিয়ে হাটতে যেতে। বাবা তোমার হাতে অনেকদিন কোন মার খাইনা, খুব ইচ্ছা হচ্ছে মার খেতে।

বাবা, তখন ছোট ছিলাম তাই অনেক কিছুই তোমাকে বলতে পারিনি। কিন্তু আজ বলব------------------

বাড়ির পাশের প্রতিবেশী চাচারা যখন ঈদে তাদের পরিবারের সবাইকে নতুন কাপড় দিত তখন তুমি চুপ হয়ে থাকতে। মা,আমি ও বোন সবাইকে ঈদে নতুন কাপড় না দিতে পারার অক্ষমতাই তোমার এই চুপ থাকার কারণ। কাপড় পেয়ে যতটুকু খুশি হতাম কিন্তু তোমার ঐ মলীন মুখ দেখে ততখানিই কষ্ট পেতাম যা কখনও বলিনি।

এক ঈদে তোমার কাছে বায়না ধরেছিলাম আমাকে পাঞ্জাবী কিনে দিতেই হবে। ঈদের আগেরদিন অনেক ঘুরাঘুরি করেও কারও কাছ থেকে টাকা না পেয়ে দোকানে বাকি চাইলে। দোকান বাকি দিল না, লজ্জায় তোমার মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে চাচাত ভাইয়ের কাছ থেকে ৮০ টাকা নিয়ে আমার পাঞ্জাবী কিনে দিয়েছিলে। সেদিন আমি তোমায় বলতে পারিনি তোমার লজ্জা পাবার বিনিময়ে আমার এ পাঞ্জাবী দরকার নেই।

স্কুলে পড়াকালীন সময়ে বেতন দেবার যেদিন শেষদিন সেদিন তুমি আমায় স্কুলে পাঠিয়ে বলতে আমি এসে বেতন দেব। কিন্তু বলতে না আমার কাছে টাকা নেই। আমি ভয়ে থাকতাম যদি টাকা না জোগাড় করতে পার। অবশেষে ঠিকই এসে বেতন দিতে তুমি। আমি সেদিন ঠিকই বুঝতাম তোমার হাতে টাকা নেই বলে স্কুলে এসে বেতন দিতে কিন্তু কিছুই বলিনি।

তুমি কোন স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ার কথা বললে আমি বলতাম প্রাইভেট পড়তে আমার ভাললাগেনা। সেদিন তোমার কথা ভেবেই আমি প্রাইভেট পড়তাম না যেন প্রাইভেট খরচের টাকাটা সংসারে ব্যয় করতে পার, যেন তোমার শরীরের ঘাম কম ঝড়ে।

আমি খুব বেশি মাছ ধরতে যেতাম বলে তুমি বলতে, " আমার ছেলে জেলে।" আমি প্রতিদিন মাছ ধরতে যেতাম যেন তোমার বাজার খরচ কমে যায় কিন্তু তোমাকে কোনদিন বুঝতে দেইনি।

বাবা, তুমি যখন মা-এর জন্য কোন শাড়ি কিনে এনে দিয়ে বলতে, " জীবনে-ত কোন কিছুই কিনে এনে দিতে পারিনি এই শাড়িটাই নাও।" তখন মা-এর মুখের হাসিটাই ছিলো অন্য সব দিনের থেকে আলাদা। সেইদিন তোমাদের কাউকেই বলতে পারিনি এমনি করে চোখের সামনে থেকো সারাজীবন।

তোমার চোখে প্রথম পানি দেখি যেদিন মা অসুস্হ হয়ে বার বার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল কিন্তু তোমার হাতে টাকা নেই এ্যাম্বুলেন্স দিয়ে শহরে নিয়ে যাবার মতো। সেদিন আমিও কেঁদে দিয়েছিলাম কিন্তু তোমাকে বলতে গিয়েও বলতে পারিনি, " আমাদের দিন পাল্টে যাবে, তুমি আর কেঁদো না বাবা।"

একটা কথা মনে পড়লে আজও কান্না ধরে রাখতে পারিনা।ছোটবেলায় একবার আমার পায়ে খেজুরের কাটা ফুটে এবং পানি বসন্ত হয় আমার শরীরে। প্রচন্ড ব্যাথা ও খুব জ্বর হয়,তখন বয়স ৭/৮ হবে। সারারাত ঘুমায়নি, আমার বাবা-মাও সারারাত আমার পাশে। মা আমার ঐ ক্ষত শরীর জড়িয়ে কোলে করে শুয়ে আছে। একটু পর দেখি বাবা-মা দুজনেই কান্না করতেসে আমার জন্য ।খুব কস্ট লাগে আজ ও ঐকথাটা মনে পড়লে।

তার চেয়ে বেশি কষ্ট লাগে আমি তখন ক্লাস অনে পড়ি। বাবা কাঠ কাটতে যেয়ে কুড়লে পা কেটে যায়। তখন আমাদের খুবই অভাব একদিন কাজ না হলে বাজার করার টাকা থাকতোনা। তার উপর বাবার পা কেটে গেছে তার চিকিৎসা।বাড়িতে সম্বল বলতে ছিলো একটা গাভী যার দুধ বিক্রি করে কোন মতে লবন ভাত খেয়ে থাকতে হতো আমাদের। আমার স্বপ্নেও মনে পড়েনা মাংসতো দুরের কথা মাছ দিয়ে ভাত খেতে পেরেছি মাসের ভিতর এক-দুই দিন।

এর মধ্যে ভালোই মনে পড়ে ঐ সময় ঈদের আগের দিন প্রচন্ড রোদ। বাবা অসুস্থ অবস্থায় আমাদের খড়কুটার সেই ছোট্র ঘরের বারান্দায় বসা। প্রচন্ড রোদে মা সারাদিন কুরবানী ঈদের পরিষ্কার পরিছন্ন করছে। এদিকে রান্না ঘর ছিলনা তাই উঠানে রোদে পুড়ে রান্না করে বারান্দায় বসে আমরা খেতাম। তবে এই দিনটা একটু অন্য রকম দিন বেদনার দিন। সারাদিন কাজ করে মা খুবি ক্লান্ত, খুবি ক্ষুদার্ত। দুপুর প্রায় বিকাল ধরব ধরব করছে একসাথে মা আমি আর বাবা ভাত খাচ্ছি। তবে দুপুরে খাবার বলতে ছিল শুধু কচুশাখ। মাকে সবসময় দেখতাম একবারের বেশি পাতিল থেকে ভাত নিতনা। তবে ঐ দিন প্রচন্ড ক্ষুধার কারণে পূর্ণরাই অর্থাৎ দ্বিতীয় বার পাতিল থেকে ভাত নেয় মা। আমি তখন এটা দেখে উঠে দাঁড়িয়ে লক্ষ করি পাতিলে আর একটিও ভাত নেই। তখন আমি হাও মাও করে কেঁদে উঠি।বাবা বলে কি হলো কি হলো বাজান? আমি তখন বলি সন্ধায় কি খেয়ে ঘুমবো । সত্যি সেদিন বাবা-মা খাওয়া রেখে আমাকে জড়িয়ে যে কান্না কাটি করেছিল তা আজও আমার হৃদয় চিরে রক্তাক্ত হয়। সেইদিন বুঝেতে পেরেছিলাম মা-বাবা রাতে আমাকে খাওয়ানো জন্য না খেয়ে থাকত প্রায় দিন।

আসলে সত্যি বলতে কি, আমি জীবনেও আমার বাবার ভালোবাসার ধরণটাই ধরতে পারিনি। তাঁর প্রতিটা কথা, প্রতিটা প্রশ্ন আমার কানে বাজে। কিন্তু কিছুই করার নেই। সে এখন আর আমাদের মাঝে নেই ।

আচ্ছা বাবা তোমার মনে আছে আমাকে বড় কাঠের পর বসিয়ে দুই টাকার বিস্কুট কিনে দিয়ে বলতে এখানে বসে খাও আমি আর কিছু কাঠ কুপিয়ে একসাথে বাড়ি যাব। সেদিন বাবা আমি বার বার ঐ দুই টাকার বিস্কুটের লোভে তোমার কাছে যেতাম। যে দিন বিস্কুট কিনে না দিতে যেদিন খুবই কষ্ট লাগতো তবে তোমাকে মুখ ফুটে বলতে পারিনি আমি কষ্ট পাইছি। আরও অনেক কথাই বলার ছিল যা বলতে পারিনি। সবশেষে শুধু এতটুকুই বলতে চাই, " বাবা যেখানেই থাকো, ভাল থেকো।" আই লাভ উ বাবা!

ইতি
তোমার আদরের এই আমি
মোঃ শাহ্ জালাল !!

এ বিচ্ছেদ আমার বাবা হারানোর বেদনা নয়, এ বিচ্ছেদ আমার সন্তান হারানোর কষ্ট !! আমি আমার বাবাকে হারাইনি আমি আমার সন্তান কে হারিয়েছি।।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: