আপনার কাছে ২১শে ফেব্রুয়ারী শোক নাকি উৎসব ??

সমসাময়িক নিউজ ডেস্ক।। | প্রকাশিত: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০১:৪২

সমসাময়িক নিউজ ডেস্ক।।
প্রকাশিত: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০১:৪২

ফাইল ফটো।

২১শে ফেব্রুয়ারীর সকালের কথা: খুব বেশী দিন নয়... আজ থেকে মাত্র ১৫/১৬ বছর আগের কথা তখন স্কুলে পড়তাম। সে সময় স্কুলে মাইক বাজতো... তবে সেটা বাংলা গান... আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি অথবা ছালাম ছালাম হাজার ছালাম সকল শহীদ স্মরণে... এই সুরেলা আয়োজনে মুখরিত ছিল পাড়া মহল্লা। রাত জেগে শহীদ মিনারকে মনের মাধুরি মিশিয়ে সাজাতাম বিভিন্নরকম ফুল সংগ্রহ করে এলাকা থেকে... সাজাতাম পাড়া ও মহল্লার গলি উপগলি। খুব ভোরে শুরু হতো প্রভাত ফেরী। খালি পায়ে লাইন ধরে শহীদ বেদীতে শ্রদ্ধার্পন। সকালে স্কুল থেকে খুলে নেয়া মাইকটাও আমাদের সঙ্গ দিতো প্রভাত ফেরীতে বাজার বা এলাকায় প্রদক্ষিনের সময়। সেদিন অবশ্য আমাকে স্কুল ড্রেস সাদা-কালো জামা পরতে হতো না... সেখানে বস্র প্রদর্শনীটা জরুরী ছিল না... ছিল হৃদয় উৎসারিত ভালবাসাটা।

২১শে ফেব্রুয়ারি এখন পানল হয় যেমন:
ঠিক রাত ১২:০১ মিনিটে টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারকৃত জাতীয় শহীদ মিনারে নেতানেতৃদ্বয়ের পুষ্পস্তবক অর্পন। সকাল থেকে সারাদিন এলাকা চষে ফেললেও একটা সাজানো মিনার চোখে পড়বে না... বরং সাদা কালো কাপড়ে সারি সারি বর্ণমালায় তৈরী পোষাক পরিধানে বর্ণমালা উৎসবে যোগদান... চকচকে নতুন জামাকাপড় পরিধান করে বেড়াতে বের হও আমাদে স্মার্ট তরুণ- তরুণীরা "রক উইথ একুশে ফেব্রুয়ারী"র অনেুষ্ঠানে হাজির হবে। দিনটা শুধু সাদাকালোয় সীমাবদ্ধ নয়... বরং হরেক রকম রঙ্গীন কাপরে উৎসবের মিছিল আজ। মহল্লার মোড়ে মোড়ে বাজছে উচ্চ ভলিয়ামে উলালা... কোলাবেরী ডি... ঠিক ঈদ উৎসব ভাবলেও ভুল হবেনা। তরুণ-তরুণী আরো যে সব কর্মকান্ডো চালাতে থাকে সেসব দিক নিয়ে আলোচনা করতে নিজেরই লজ্জা লাগে আজ।

তাই নতুনদের অবস্থাটা দেখে কিছুটা অবাক হই। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষায় হিন্দী গান বাজানোটা ঠিক নিষেধের পর্যায় পড়ে কিনা ? কারণ, হিন্দিওতো একটা ভাষা। ঠিক ভেবে উঠতে পারি না এসব। ভাবি হয়ত স্কুল গুলোতে সরকারি কারিকুলামে এভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে একুশ পালনে। সেটাই শিখছে নতুন প্রজন্ম। আমরা এখন পুরান তাই হয়তো অনেক কিছুই জানি না ... অনেক কিছুই ঠিক মত হয়তো বুঝিও না। নিজেদের আজকাল বড় অসহায় মনে হয়।

ফিরে দেখা ২১শে ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ ইতিহাস:
ভাষা আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন, যা ছিল বাংলা ভাষাকে তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এই আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নিলেও বস্তুত এর বীজ বপিত হয় বহু আগে, এবং এর ফলও ছিল সুদূরপ্রসারি।

রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার অধিকার আদায়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় আয়োজিত মিছিল
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়, কিন্তু পাকিস্তানের দুটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান (পূর্ব বাংলা হিসেবেও পরিচিত) ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে পার্থক্য ছিল প্রচুর। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, যা পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী জনগণের মধ্যে তুমুল ক্ষোভের সৃষ্টি করে। পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী মানুষ (যারা সংখ্যার বিচারে সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল) এ সিদ্ধান্তকে মোটেই মেনে নিতে চায়নি। পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর খাজা নাজিমুদ্দিন জানান যে পাকিস্তান সরকারের সিদ্ধান্তই মেনে নেওয়া হবে। এই ঘোষণার ফলে আন্দোলন আরো জোরদার হয়ে ওঠে।

পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে মিটিং-মিছিল ইত্যাদি বেআইনি ঘোষণা করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) এই আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুসংখ্যক ছাত্র ও কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে মিছিল শুরু করেন। মিছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ মিছিলের উপর গুলি চালায়। গুলিতে নিহত হন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ আরো অনেকে । এই ঘটনায় সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে কেন্দ্রীয় সরকার গণআন্দোলনের মুখে নতি স্বীকার করে এবং ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান করে।

২১শে ফেব্রুয়ারী ১৯৫৬ সাল শহীদ বরকতের মা, ২০০০ সালে ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন ও মানুষের ভাষা ও কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করে।

রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই আন্দোলনের মাধ্যমেই প্রথম বাংলা ভাষার রাষ্ট্র চাই ধারণাটির জন্ম হয় এবং এ ধারণাই পরবর্তীতে বিভিন্ন বাঙালি জাতীয়তা আন্দোলন, যেমন ৬ দফা আন্দোলন এবং পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রেরণা যোগায়। বাংলাদেশে ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস হিসেবে উদযাপিত হয় এবং দিনটিতে জাতীয় ছুটি থাকে। এ আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে।

একুশে ফেব্রুয়ারী গানটির সৃস্টি:
২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণের ঘটনার পর, একুশ নিয়ে প্রথম গান লেখেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। গানটি হল, "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।" প্রথমে আব্দুল লতিফ সুর দেন। পরে করাচী থেকে ঢাকা ফিরে ১৯৬৯ সালে আলতাফ মাহমুদ আবার নতুন সুর দিলেন। সেই থেকে ওটা হয়ে গেল একুশের প্রভাত ফেরীর গান। ১৯৫৪ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে সংকলনে প্রকাশিত গানটি। তৎকালীন সরকার সংকলনটি বাজেয়াপ্ত করে। জহির রায়হান তার জীবন থেকে নেয়া ছবিতে এই গানটি ব্যবহার করার পর এর জনপ্রিয়তা আরো বেড়ে যায়। ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাবার পর এই গানটিও আন্তর্জাতিকতা পেতে শুরু করে।

আরো একটি তথ্য মতে, একুশে ফেব্রুয়ারী নিয়ে প্রথম কবিতা লিখেছিলেন মাহবুবুল আলম চৌধুরী, 'কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি' ।
ওরা আমার মুখের কথা কাইরা নিতে চায়
ওরা আমার মুখের কথা কাইরা নিতে চায়
ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে-পায়ে
ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে-পায়ে
ওরা আমার মুখের কথা কাইরা নিতে চায়
কইতো যাহা আমার দাদা, কইছে তাহা আমার বাবায়
কইতো যাহা আমার দাদায়…
এখন কও দেহি ভাই মোর মুখে কি অন্য কথা শোভা পায়!
ওরা আমার মুখের কথা কাইরা নিতে চায়
ওরা আমার মুখের কথা কাইরা নিতে চায়
সইমু না আর সইমু না, অন্য কথা কইমু না
যায় যদি ভাই দিমু সাধের জান, যায় যদি ভাই দিমু সাধের জান,
জানের বদ রাখুম রে ভাই, বাব-দাদার জবানের দাম
এই যে শুইনাছে আমার দেশের গাঁওগেরামের গান
নানান রঙয়ের নানার রসে, ভইরাছে তার প্রাণ
যপ-কীর্তন, ভাসান-জারি, গাজীর গীত আর কবি সারি
যপ-কীর্তন, ভাসান-জারি….
আমার এ বাংলাদেশ এর বয়াতিরা নাইচা নাইচা কেমন গায়
ওরা কাদের মুখের কথা কাইরা নিতে চায়!.....

মন্তব্য:
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শুধু এ দেশের ছাত্রসমাজ না, সমগ্র জনতা নিজেদের ভাষা বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম, সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে ও রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। এ সংগ্রামে তাদের এক ধরনের রাজনৈতিক সাফল্য এসেছিল। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার এরপর বাংলাকে বাদ দিয়ে পূর্ববাংলার জনগণের ওপর উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার আর কোনো চেষ্টা করেনি এবং সে আন্দোলনের জের হিসেবেই ১৯৫৪ সালে এ দেশের মাটি থেকে মুসলিম লীগ সাংগঠনিকভাবে উৎখাত হয়েছিল। এ কারণে ২১ ফেব্রুয়ারি এখন পর্যন্ত জনগণের চেতনায় এমন বড় স্থান অধিকার করে আছে, যা অন্য কোনো দিবসের দ্বারা উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও আজকাল ফেব্রুয়ারি মাস এলে এবং ২১ ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে যেসব তৎপরতা চলতে থাকে তার দিকে তাকিয়ে খুশি অথবা উচ্ছ্বসিত হওয়ার কোনো কারণ আমি দেখি না। কারণ, এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে প্রাণের কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। উপরন্তু এক দিগন্ত বিস্তৃত ভণ্ডামির রাজত্বই পুরো ফেব্রুয়ারি মাস ধরে চলতে থাকে, তা দেখে মর্মাহতই হতে হয়। দয়া করে এসব বন্ধ করা হোক। শিক্ষক দের কাছে অনুরোধে নতুন প্রজন্মকে আপনারা বাঁচান!

লেখক- মোঃ শাহ্ জালাল।। 




আপনার মূল্যবান মতামত দিন: