মণিরামপুরের আকাশে মেঘ দেখলেই লাখো মানুষের চোখে মুখে ফুটে উঠে অজানা আতংকের ছাপ

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ৪ অক্টোবর ২০২১ ০৯:১৩

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ৪ অক্টোবর ২০২১ ০৯:১৩

ছবি সমসাময়িক

নিউজ ডেস্ক, মণিরামপুর(যশোর)থেকে ফিরে।।

উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে আজ দেশ ও দেশের বহু জনপদ। শুধু পরিবর্তন হয়নি মণিরামপুর ভবদহ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নের চাকা। আজ বলতে হয় মানবী প্রিয়া তোর যৌবন চলে যায় পদ্মা তো চিরযৌবনা। যশোরের আরো একটি পরিচিত নামের অনুসূচনা হলো, যার নাম দেওয়া হয়েছে দুঃখ। কেননা আজ দুঃখ নামে পরিচিত জেলার মণিরামপুর উপজেলার ভবদহ অঞ্চল। জলাবদ্ধতা ও পানিতে পলি জমে রুদ্ধ হয়ে আছে নদীর গতি পথগুলো। যা ভবদহ অঞ্চলে আটকে পড়া পানি নিষ্কাশনের বড় বাধা। ফলে প্রতিবছর জলাবদ্ধতার নির্মম যন্ত্রণা সইতে হচ্ছে এ অঞ্চলের লাখো মানুষকে। বছর পেরিয়ে যুগ পেরিয়েছে, এই জলাবদ্ধতার স্থায়ী কোনো সমাধানে এগিয়ে আসেনি কেউই। অথচ ফেসবুক ফেস্টুন ব্যানার প্ল্যাকার্ড এর বড় বড় অক্ষরে লেখা বুলিতে ভাসছে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। কিছু আতি নেতা পাতি নেতা চামচা এই ধরনের ফাঁকা আওয়াজ দিয়ে প্রকৃত উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। ক্ষমতার পালা বদলের সঙ্গে রাজনীতি শুরু হয়েছে ভবদহের মানুষদেরকে নিয়ে। এ দুঃখ কবে সমাধান হবে তাও কেউ বলতে পারে না। এবারও ভবদহে সে দুঃখ দেখা দিয়েছে। ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে ভবদহ অঞ্চলে। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছে। উপজেলার অধিকাংশ গ্রাম, বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট, বিদ্যালয়ের মাঠ, বারান্দা ও শ্রেণিকক্ষে ভারী বৃষ্টি পানিতে আজ প্লাবিত। ভবদহ এলাকার এই স্থায়ী জলাবদ্ধতা যা দীর্ঘদিনেও সমাধান হয়নি। তার ওপর গত কয়েকদিনের ভারি বৃষ্টিতে সেই স্থায়ী জলাবদ্ধতা এখন অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পরিনত। এলাকার অন্তত সাতশ বাড়িঘর, পাঁচ শতাধিক মৎস্যঘের, প্রায় দুই হাজার হেক্টর ফসলের ক্ষেত এবং প্রায় ৫০টির বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ফলে মহামারি করোনার কারণে প্রায় দেড় বছর পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর পুনরায় চালু হলেও ভবদহ এলাকায় এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ হলেও এই সমস্যার সমাধানের নেই কোনো অগ্রগতি। গত সপ্তাহে সরেজমিনে দেখা যায়, কয়েকদিনের বৃষ্টিতে হরিদাসকাটি ইউনিয়নের চান্দুয়া সমসকাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠ তলিয়ে শ্রেণিকক্ষের বারান্দা পর্যন্ত পানি উঠেছে। রাস্তা থেকে শিক্ষার্থীদের পানি ভেঙে শ্রেণিকক্ষে আসতে হচ্ছে। সকাল ১০টায় কয়েকজন ছাত্রীকে বিদ্যালয়ের ডুবে যাওয়া মাঠ ভেঙে শ্রেণিকক্ষে আসে। দশম শ্রেণির ছাত্রী সামিরা খাতুন, রাজিয়া সুলতানা, পারুল খাতুন জানায়, মাঠ ছাড়াও বিদ্যালয়ের বারান্দা ডুবে গেছে। শুধু শ্রেণিকক্ষেই তাদের অবস্থান করতে হচ্ছে। একই চিত্র চোখে পড়েছে নেহালপুর ইউনিয়নের বালিদহ পাঁচাকড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। পানিবন্দি মাঠ পেরিয়ে জামাকাপড় ভিজে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে আসতে হচ্ছে। তারপরও তারা ক্লাস করতে পেরে খুশি। আবার হাটগাছা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষেই পানি উঠে গেছে। সেখানে ইট দিয়ে মেঝে উঁচু করা হয়েছে। বালিদহ পাঁচাকড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সঞ্জিত মণ্ডল জানান, পানি ভেঙে আসতে তাদের সবার বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ম্যানেজিং কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে মাঠে বাঁশের সাঁকো স্থাপনের। চান্দুয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাপস কুমার পাল বলেন, ঝুঁকির মধ্যে অতিকষ্টে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের পাঠদান চলছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী ভবদহের সমস্যা সমাধানের জন্য একেক পক্ষ একেক রকম দাবি তুলে প্রতিদিন সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদান করছে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ে তাদের এ প্রতিধ্বনি শোনা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ১০ বছরে পানি উন্নয়ন বোর্ড বিল কপালিয়ায় প্রস্তাবিত জোয়ারাধার বা টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) চালু করতে পারেনি। এই অঞ্চলের পানি নিষ্কাশনের একমাত্র পথ হরি, শ্রী ও টেকা নদীতে ব্যাপকহারে জোয়ারের সঙ্গে আসা পলি জমে নদীর বুক উঁচু হয়ে যাওয়ায়, বন্ধ হয়ে গেছে পানি নিষ্কাশনের একমাত্র ও প্রধান পথ। অউপকূল অঞ্চলে বেড়িবাঁধ দিয়ে চিংড়ি মাছ চাষ ও সবুজায়নের অংশ হিসেবে নোনাপানি ঠেকাতে ১৯৫৮ সাল থেকে তৎকালীন সরকার নদী শাসন শুরু করে। ১৯৬২ সালে ভবদহের ওপর পাঁচটি স্থানে বসানো হয় ৪৪টি স্লুইসগেট। এতে জোয়ারের পানি বাধাগ্রস্ত হওয়ায় নদী তার স্বাভাবিক গতি হারাতে থাকে। জোয়ারের সঙ্গে আসা পলি জমে নদীর বুক উঁচু হতে থাকে। ১৯৮১ সালে ভবদহের পাশের কয়েকটি বিলে প্রথম দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। ক্রমান্বয়ে ৫২টি বিলে স্থায়ী জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এতে করে ওই বিলের নিম্নাংশে দিকে ফসল ফলাতে ব্যর্থ হয় কৃষক। নিরুপায় হয়ে ১৯৮৮ সালে ডহুরী বিলের বাঁধ কাটা হয়। এরপর ১৯৯০ সালে বিল ডাকাতিয়ার বাঁধ কাটা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে বাঁধ কাটার ধারাবাহিকতায় ভবদহের আগরহাটি-ভায়না বিলের স্থানীয় বাসিন্দারা নদীসংলগ্ন ভায়না বিলের বেড়িবাঁধ কেটে দেয়। এতে নদীর পলিযুক্ত পানি ওই বিলে প্রবেশ করে। আর সেই সঙ্গে বেরিয়ে যায় স্বচ্ছ (মিঠা) পানি। এভাবে পলিতে একদিকে বিল উঁচু হতে থাকে। অন্যদিকে নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি পায়। এ কারণে তৎকালীন সরকার ১৯৯৮ সালে নদীর নাব্যতা ঠিক রাখার জন্য প্রথম ওই বিলে জোয়ারাধার প্রকল্প চালু করে। স্থানীয়রা জানান, ওই জোয়ারাধার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষকদের শতশত বছরের পুরানো নিজস্ব উদ্ভাবিত একটি কৃষি-পদ্ধতি। অতীতে কৃষকরা বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে বাঁধ দিয়ে নোনা পানি ঠেকিয়ে আবাদ করতেন। আবার আবাদ শেষে বাঁধ কেটে জোয়ারের পলি তুলে বিল উঁচু করে নিতেন। এর নাম অষ্টমাসী বাঁধ। মাঘি পূর্ণিমায় বাঁধ দিয়ে আষাঢ়ি পূর্ণিমায় খুলে দেওয়া হতো। এইভাবে একই সঙ্গে চলত চাষাবাদ আর ভূমি গঠনের কাজ। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, জোয়ারভাটা চালুর জন্য মূল নদী সংলগ্ন যে কোনো একটি নির্বাচিত বিলের তিনদিকে পেরিফেরিয়াল বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এরপর অবশিষ্ট দিকের বেড়িবাঁধের একটি অংশ উন্মুক্ত করে বিলে জোয়ারভাটা চালু করা হয়। এটাই জোয়ারাধার । ভবদহ এলাকার জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য সাগর থেকে জোয়ারের সঙ্গে আসা পলি পর্যায়ক্রমে এলাকার একটি করে বিলে ফেলা হয়। এতে ওই বিল উঁচু করার পাশাপাশি নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি পায়। আর এ কাজের জন্য ‘ভবদহ ও তৎসংলগ্ন বিল এলাকায় জলাবদ্ধতা দূরিকরণ প্রকল্প’ গ্রহণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এভাবে প্রতি বিলে জোয়ারাধার চলবে তিন বছর ধরে। সূত্র মতে, জোয়ারাধার চলাকালে ওই বিলে কোনো ফসল হবে না। এ জন্য কৃষকদের ফসলের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় পাউবো। ২০০১ সালে পাউবোর ভুল সিদ্ধান্ত, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতির জন্য বিল কেদারিয়ায় গ্রহণ করা জোয়ারাধার ফলপ্রসু হয়নি। ফলে নদী আবারো ভরাট হতে থাকে। ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে ৪ দফা বৃষ্টিতে এলাকায় পূনরায় ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে দুই বছর মানবেতর জীবনযাপন করে। জলাবদ্ধতা দূরীকরণের অংশ হিসেবে ২০০৬ সালে কেশবপুর উপজেলার বিল খুকশিয়ায় তিন বছর মেয়াদী জোয়ারাধার চালু করা হয়। এ প্রকল্প চালু করা হলেও বিলের পাঁচ হাজারের বেশি কৃষক ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হয়। এ সময় বিলে কোনো ফসল হয়নি। কিন্তু ক্ষতিপূরণের আওতায় আনা হয় মাত্র এক হাজার কৃষককে। তালিকাভুক্ত কৃষকের অর্ধেকও ফসলের ক্ষতিপূরণ পাননি। ২০০৮ সালে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা অব্যাহত থাকে। বিল খুকশিয়ার পর চতুর্থ বিল হিসেবে মনিরামপুর উপজেলার বিল কপালিয়ায় জোয়ারাধার চালুর চেষ্টা চালায় পানি উন্নয়ন বোর্ড। ফসলের অগ্রিম ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। টাকাও বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু বিলের বেশিরভাগ কৃষক ক্ষতিপুরণের অগ্রিম টাকা পাওয়ার জন্য আবেদন করেননি। এই অবস্থায় ২০১২ সালের মে মাসে বিল কপালিয়ায় জোয়ারাধার নির্মাণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়। ওই বছরের ২ জুন জোয়ারাধার নির্মাণের অংশ হিসেবে পেরিফেরিয়াল বাঁধ নির্মাণ করতে গেলে এলাকাবাসীর প্রতিরোধের মুখে হামলার শিকার হন তৎকালিন হুইপ যশোর-৬ আসনের সংসদ শেখ আব্দুল ওহাব, অভয়নগর উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাসহ কমপক্ষে ২৬ জন। থেমে যায় জোয়ারাধার প্রকল্প। ফলে পলিতে ভরাট হতে থাকে হরি, শ্রী ও টেকা নদী। ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত বিক্ষুব্ধ কৃষকরা গোরসয়ালে হরি নদীর সঙ্গে বিল খুকশিয়ার কাটিং পয়েন্ট বেঁধে দেন। এতে বন্ধ হয়ে যায় বিল খুকশিয়ায় জোয়ারাধার। ভবদহের জলাবদ্ধতা নিরসনে দীর্ঘদিন ধরে ‘ভবদহ জলাবদ্ধতা নিরসন সংগ্রাম কমিটি’ ও ‘ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি’ আন্দোলন করে আসছে। এ বছরও উদ্ভুত পরিস্থিতিতে দ্রুত পানি সরানো এবং জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানের জন্য শ্যালোমেশিন বসিয়ে কোন লাভ হয়নি। তবে বিভিন্ন দাবিতে দুটি সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন শুরু করেছে। তারা প্রতিনিয়ত সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ, স্মারকলিপি পেশ, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছেন। কিন্তু দীর্ঘ এই জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান কোথায় ??


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: