চিঠি আছে, চিঠি-ডাকপিয়নের এমন ডাক আজ আর শোনা যায় না

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ৫ ডিসেম্বর ২০২১ ০১:২৯

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ৫ ডিসেম্বর ২০২১ ০১:২৯

ছবি সমসাময়িক

মোঃ শাহ্ জালাল।। 

ছোট্ট দুই অক্ষরের একটি শব্দ ‘চিঠি’। কিন্তু একটা সময়ে কী বিশাল আর ব্যাপক ছিল তার আবেদন। কত রোমাঞ্চ, ভালো লাগা, ভালোবাসা, আদর আর আশীর্বাদে ভরা ছিল সেই চিঠিগুলো। কতশত সুসংবাদ আর দুঃসংবাদ বয়ে নিয়ে আসত এই চিঠি। চিঠি আছে, চিঠি- ডাকপিয়নের এমন ডাক যেমন পাড়া-মহল্লায় আগের মতো শোনা যায় না, তেমনি বর্তমান প্রজন্মের মাঝে চিঠি লেখার প্রবণতাও উঠে গেছে। চিঠিপত্রের বিলুপ্তির সঙ্গে আরেকটি পেশাজীবী গোষ্ঠীও পুরোপুরি হারিয়ে গেছে। সেটি হচ্ছে ‘পত্র বা চিঠি লেখক’। একটা সময়ে চিঠিপত্র আদান-প্রদানের ব্যাপক প্রচলন ছিল। মানুষ প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে চিঠি লিখত তাদের প্রিয়জনের কাছে। লিখত পরিচিত-অপরিচিতদের কাছে। উর্ধতন-অধতন কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছে। সে সময়টাতে ডাকঘরের বারান্দায় মানুষের ভিড় লেগেই থাকত। কখন ডাকঘর খুলবে, সে আশাতে মানুষ আগ থেকেই অপেক্ষা করত। দু-আড়াই দশক আগের পত্রপত্রিকা খুললেও তার প্রমাণ মিলবে মানুষের কাছে ডাকঘর কতটা প্রয়োজনীয় দফতর ছিল। ডাকঘরে ডাকটিকিট, ইনভেলাপ, মানিঅর্ডার ফরম বা পোস্টকার্ডের সঙ্কট এমন সংবাদ হরহামেশা সংবাদপত্রের পাতায় ছাপা হতো। ডাক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠার সময় থেকেই ধীরে ধীরে চিঠিপত্রের অপরিহার্যতা বাড়তে শুরু করে। যা পরে মানুষের কাছে ‘একান্ত প্রয়োজন’ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, চিঠিপত্রের আদান-প্রদান যে দ্রুততায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, সে তুলনায় স্বাক্ষর কিংবা প্রতিষ্ঠানিক লেখাপড়া জানা মানুষের সংখ্যা বাড়েনি। ফলে এ শূন্যতার মাঝে গড়ে উঠেছিল ‘চিঠি লেখক’ পেশাজীবী গোষ্ঠী। যারা চিঠিপত্র কেন্দ্র করে নিজেদের রুটি-রুজির সংস্থান করে নিয়েছিল। রাজধানী থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলা এবং প্রত্যন্ত গা-গেরাম পর্যন্ত ছিল পত্রলেখক পেশাজীবীদের বিচরণ।রাজধানীতে তারা জিপিওসহ ডাকঘরগুলোর বারান্দা কিংবা আশপাশে চেয়ার-টেবিল পেতে বসত। তাদের কাছে থরে থরে সাজানো থাকত নানান রঙের খাম। লাল, সবুজ, কালো কালির কলম। থাকতো আঠা বা গাম। ইনভেলাপ, ডাকটিকিট, পোস্টকার্ড তো থাকতই। জেলা-উপজেলা কিংবা গাঁ-গেরামে এমন সাজানো গোছানো চেয়ার-টেবিল না থাকলেও ডাকঘরের আশপাশের পান কিংবা স্টেশনারী দোকানগুলোতে এ ব্যবস্থা। বহু ডাকঘরের বারান্দাতেও এ শ্রেণীর পেশাজীবী মানুষের দেখা মিলত। তাদের কাজ ছিল লেখাপড়া না জানা মানুষদের কাছে আসা চিঠিপত্র পড়ে দেয়া। আবার প্রয়োজনে তার উত্তর লিখে দেয়া। এর বিনিময়ে তারা পেত পারিশ্রামিক। অর্থাৎ লেখাপড়া না জানা লোকজনদের কাছে চিঠি লেখকরা ছিল বাতিঘরের মতো। প্রবীণরা জানিয়েছেন, পাকিস্তান আমলের গোড়াতে দু-চার পয়সার বিনিময়ে পত্রলেখকজীবীরা এ সেবা দিত। পরে ধাপে ধাপে তা এক আনা, দু’আনা থেকে চার আনা-আট আনায় উন্নীত হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুতেও এ ধরনের কাজের সম্মানী বা পারিশ্রামিক এক-দুই টাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। যা পরে পঞ্চাশ থেকে একশ’ টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। ইংরেজী চিঠি পড়া এবং লেখার জন্য বেশি অর্থ নেয়া হতো। পত্রলেখক পেশাজীবীদের অনেকের কাছে টাইপ রাইটারও। ছিল যারা দু’হাতের দশ আঙ্গুল দিয়ে খটাখট শব্দ তুলে সাদা কাগজের বুকে নির্ভুল বানানে চিঠি লিখে দিত। সরকারী-বেসরকারী দফতরে আবেদনের কাজও তারা করত।সারাদেশে এমন পেশাজীবীর সংখ্যা কত ছিল, তা অনুমান করা কষ্টসাধ্য। তবে প্রায় প্রতিটি ব্যস্ত ডাকঘর ঘিরেই দু-চারজন ছিল, যা নিঃসন্দেহে ধারণা করে নেয়া যায়। অন্য পেশাজীবীদের তুলনায় পত্রলেখকজীবীদের আয় যে একেবারে কম ছিল না, তা সহজে ধারণা করে নেয়া যায়। যে কারণে ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে এক-দেড় দশক আগ পর্যন্ত তাদের পদচারণা ছিল রমরমা। পত্রলেখকজীবীদের মধ্যে যেমন বয়সে তরুণদের দেখা মিলত, তেমনি ভারি কাঁচের চশমা পড়া বয়োবৃদ্ধদের লম্বা লাইনও ছিল। কেউ কেউ অবসরে অন্য কাজের ফাঁকে এ কাজ করত। আবার অনেকে সার্বক্ষণিক এ পেশায় ছিল। ডাকঘরের কর্মচারীরাও ফাঁক-ফোকরে এ কাজ করে বাড়তি দু’পয়সা রোজগার করত। সময়ের বিবর্তনে বদলে গেছে অনেক কিছুই। বিলুপ্তির পথে চলে গেছে চিঠি লেখার প্রচলন। সে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে গেছে চিঠি লিখিয়েরা। এখন আর ডাকঘরের বারান্দা কিংবা আশপাশের দোকানে তাদের দেখা মেলে না। রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে/রানার চলেছে, খবরের বোঝা হাতে,/রানার চলেছে রানার!’’কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার রানারের দেখা মেলে না প্রযুক্তির এ যুগে।


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: