যশোর হানাদার মুক্ত দিবসের মহা নায়ক ছিলেন খান টিপু সুলতান

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ৫ ডিসেম্বর ২০২১ ১৮:৪৭

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ৫ ডিসেম্বর ২০২১ ১৮:৪৭

ছবি সমসাময়িক

মোঃ শাহ্ জালাল।। 

১৯৬৯ সালের ছাত্র-গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেন টিপু সুলতান। এই আন্দোলনের শুরতেই যশোরের সরকারী এম. এম. কলেজ থেকে তার নেতৃত্বে প্রথম মিছিল বের হয়। এসময় তিনি যশোরের ছাত্র সমাজের কাছে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। শুধু ছাত্র সমাজে নয় পুরো যশোরে অনেক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের পর পর যশোর জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং ওই সম্মেলনে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন খান টিপু সুলতান। এ সময়ে আইয়ুব খানের পতন এবং ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা আসে। এর কিছুদিন পর যশোরে মুসলিম লীগের নেতা নূরুল আমিনের আগমন নিয়ে গণপ্রতিরোধ সৃষ্টি করেছিলেন। এ ঘটনায় খান টিপু সুলতানসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে সামরিক আদালতে মামলা হয়। বিচারে তাদের ৬ মাসের কারাদন্ড হয়। তিনি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে গ্রেফতার এড়িয়ে ’৭০-এর নির্বাচনী প্রচারণার জন্য চট্টগ্রাম ও খুলনার বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থান করেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ব্যাপক বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঢাকায় পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বৈঠক হয়। বৈঠকে খান টিপু সুলতানসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার করতে বঙ্গবন্ধু অনুরোধ করেন ইয়াহিয়া খানকে। এর প্রেক্ষিতে মামলা প্রত্যাহার হয়। ১৯৭১ সালের প্রথম দিকে যশোর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি হিসেবে ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তারা সশস্ত্র লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নেন। এসময় এক বিশেষ মুহুর্তে তাদের মিছিলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গুলি চালায়। ৩ মার্চের সেই মিছিলে যশোরে প্রথম শহীদ হন চারুবালা। চারুবালা যখন গুলিবিদ্ধ হন টিপু সুলতান ছিলেন তার পাশেই। চারুবালার মরদেহ নিয়ে রাজপথে সেদিন মিছিল করেছিল ছাত্র সমাজ। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ নিয়াজ পার্ক হিসেবে পরিচিত কালেক্টরেট ময়দানে মঞ্চ তৈরি করে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা পতাকা উত্তোলন করেন টিপু সুলতান ও তার রাজনৈতিক সহযোদ্ধারা। এ সময় তিনি সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করেন। সে দূর্লভ মুহূর্তের ছবি এখনও যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরি ও যশোর সেনানিবাসের জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাক সেনাবাহিনী যখন সশস্ত্র হামলা চালায় তখন খান টিপু সুলতান ছিলেন এম. এম কলেজের বর্তমান পুরাতন হোস্টেলে। সে সময় ছাত্র-জনতাকে নিয়ে তারা ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন আরবপুর মোড়ে ব্যারিকেড দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পাক সেনাদের গতিরোধ করার জন্য যে বোমা হামলা চালানো হয় তার নেতৃত্ব ছিলেন খান টিপু সুলতান। প্রথম দফা ব্যর্থ হয়ে রাত্র ১টার দিকে পাক সেনাবাহিনী আবার শহরে প্রবেশ করে। তারা এম. এম. কলেজের হোস্টেলে ব্যাপক তল্লাসী চালায়। খান টিপু সুলতানকে খোঁজাখুজি করে না পেয়ে বই ও আসবাবপত্র নিয়ে যায়। খান টিপু সুলতান ঐ রাতে হোস্টেলে অবস্থান না করায় প্রাণে বেঁচে যান। পরদিন ২৬ মার্চ সকাল থেকে পাক সেনাবাহিনী খান টিপু সুলতানকে ধরিয়ে দিতে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে; মাইকে ঘোষণা দেয়। তাকে বার বার আত্নসমর্পণের জন্য বলা হলেও টিপু সুলতান শহরের কাজী পাড়ায় মিঞা মতিনের বাড়ীতে আত্মগোপন করে থাকেন। সেখানে দু’দিন অবস্থানের পর ২৭ মার্চ চলে যান হাসান শিবলীর বাড়িতে। এই অবস্থায় বঙ্গবন্ধু ও রাজনৈতিক সহপাঠিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রতিরোধ সংগ্রামের মানসিক প্রস্তুতি জোরদার করেন। ৩০ মার্চ ইপিআর ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী পরাজিত হলে শহর মুক্ত হয়। এ সময় খান টিপু সুলতানের নেতৃত্বের মিছিল বের হয় এবং কন্ঠ শিল্পী শাহ মোঃ মোরশেদ রাজপথে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
পরে পাক হানাদার বাহিনী আবার শহরে প্রবেশ করলে তিনি যশোর শহর ছেড়ে নড়াইলে অবস্থান নেন। এর দু’দিন পর তিনি বাঘারপাড়া, ডুমুরিয়া ও মনিরামপুরে আত্নগোপন করে সাংগঠনিক কাজ করেন। হানাদারদের আক্রমণের এক পর্যায়ে ইপিআর সদস্যরা ছত্রভঙ্গ হলে টিপু সুলতান ভারত যান মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে। জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে যোগাযোগ হলে তার নির্দেশ ও নেতৃত্বে বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় ছাত্রদের নিয়ে একটি স্পেশাল অপারেশান গ্রুপ গঠন করে তাদের নিয়ে বিহারের চাকুলিয়াতে সশস্ত্র ট্রেনিং নেন তিনি। সেখানে ট্রেনিং শেষে ফিরে আসেন দেশে। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার তাকে যশোর সেক্টরে স্টুডেন্ট পলিটিক্যাল লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেন। তৎকালীন সেক্টর কমান্ডার মেজর ওসমান তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। তিনি যশোর সেক্টরে গেরিলা যোদ্ধাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়ে অগ্রসর করার দায়িত্ব পালন করেন। প্রত্যেকটি অপারেশন ক্যাম্পে গিয়ে তাদের সংগঠিত করেন এবং প্রশিক্ষণ দেন। তার পরামর্শে বিভিন্ন মহকুমা ও থানায় এফ. এফ কমান্ডার নিয়োগ দেন সাব-সেক্টর কমান্ডাররা।
চৌগাছায় জাহাঙ্গীরপুর গ্রামে এসে সশস্ত্র সহযোদ্ধাদের নিয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং চৌগাছার সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন খান টিপু সুলতান। এ যুদ্ধ হয়েছিল চৌগাছা থানার বেশিরভাগ এলাকা জুড়ে। দু’পক্ষই এ যুদ্ধে ট্যাংক ব্যবহার করে। মিত্র বাহিনী যুক্ত হওয়ায় এটি ভয়াবহ যুদ্ধে রূপ নেয়। হানাদাররা টিকতে না পেরে অনেক ক্ষয়ক্ষতির পর ৩ ডিসেম্বর পিছু হঠতে বাধ্য হয়। ৬ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হয় ঘোষণা করা হয়। এবং ৭ ডিসেম্বর যশোর পুরোপুরি হানাদার মুক্ত হয়।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: