নৌকায় জন্ম, সংসার ও মৃত্যু

দৈনিক সমসাময়িক নিউজ ডেস্ক।। | প্রকাশিত: ২৬ জানুয়ারী ২০২৪ ০৭:৫৪

দৈনিক সমসাময়িক নিউজ ডেস্ক।।
প্রকাশিত: ২৬ জানুয়ারী ২০২৪ ০৭:৫৪

ছবি- নিউজ ডেস্ক।।

নৌকা থেকে লাফ দিয়ে বিয়ে, স্বামীর নৌকা থেকে লাফ দিয়ে বাবার নৌকায় গেলেই তালাক! এককথায় নৌকায় জন্ম,সংসার ও মৃত্যু!

নদীর নাম আড়িয়াল খাঁ। নদীতে মাত্র ৫-১০ হাত লম্বা একটি নৌকা। এ নৌকাতে জন্ম, বেড়ে উঠা, সংসার এবং জীবনের শেষক্ষণ মৃত্যু। এ কথাগুলো খুব ছোট মনে হলেও বিষয়টি বিশাল ও ব্যাপক।

বলছি, নদীতে ভাসমান কিছু জীবন্ত মানুষের কথা। যারা জীবন চালাতে কিছু উপকরণকে সঙ্গী করে প্রান্ত থেকে তেপান্তরে ছুটে চলে। মাত্র একটি নৌকায় তার জীবন-পরিবার-সংসার-বেড়ে উঠা।

আজ সকাল বেলা চারিদিকে কনকনে শীত ও প্রচন্ড ঘন কুয়াশায় বরিশালের চরমোনাই বুখাইনগর বাজারের পাশেই আড়িয়াল খাঁ নদীর পাড়ে চোখে পড়ল সারি সারি ছোট-বড় নৌকার মিলন মেলা। সামনে যেতেই দেখি একটি নৌকাতে পরিবারসহ অনেকগুলো মানুষ। প্রতিটি নৌকা একটি বাড়ি, একটি পরিবার, একটি সংসার। প্রতিটি নৌকাতে ৬-৭ জন করে মানুষ আছে। কেউ রান্না করছে, কেউ পানি তুলছে, কেউ মাছ কাটছে, কেউ চুলায় আগুন দিচ্ছে, কেউ আবার খাচ্ছে। সবাই যেন সুখেই দিনপার করছে। কিন্তু কিভাবে?

ধর্মে তারা মুসলমান। তবে জীবনযাত্রা বহুবিচিত্র। তাদের চলা-ফেরায় মনে হয় ভিন্ন সম্প্রদায়। এদের মানতা সম্প্রদায় গোষ্ঠীর মানুষ বলা হয়। তাদের আয়-রোজকার সবকিছু নদী। নদীতে মাছ শিকার করা একমাত্র উপার্জনের পথ। ছেলে-মেয়ে উভয় মাছ ধরতে পারদর্শী। কেউ কাউকে মাছ ধরতে ছাড় দিতে রাজি না। কোনো অংশে ছেলে-মেয়ে পার্থক্য নেই। মাছ ধরাই তাদের মূল আয়ে

নৌকাতে বড়দের সঙ্গে ছোট-বড় ছেলে-মেয়ে দেখা যায়। এদের জন্ম নৌকাতেই। এরা একটু বড় হলে সময়ের সাথে নদীতে মাছ শিকার করে। দেশের পদ্মা, মেঘনা যমুনা প্রতিটি৷ নদীর পাড়ে প্রায় ১২০-১৫০ টি নৌকা পরিবারের বসবাস। আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরে প্রায় ১২-১৫ বছর যাবত জীবনযাপন করছে। কেউ আবার তার বেশি সময় বসবাস করে এসেছে।

এ মানুষগুলোর শিক্ষা নেই বললেই চলে। এদের সন্তানদের ও শিক্ষা নেই। এরা যেমন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ঠিক এদের নতুন প্রজন্ম সন্তানেরা ও শিক্ষা ও মৌলিক চাহিদার মধ্যে শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, বিশুদ্ধ পানি, খাদ্য কোনটাই নেই। এরা নদীতে ভাসমান অবস্থায় নদীতেই টয়লেট করে। নদীর পানি পান করে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিশুদ্ধ পানির অভাবে ৮০% পানিবাহিত রোগ ডাইরিয়ায় আক্রান্ত সহ ঠাণ্ডাজনিত জ্বর, কাশি, হাপাঁনি, নিউমোনিয়া সহ মারাত্মক রোগে ভোগে। সঠিক সময় চিকিৎসা নিতে পারে না। স্থায়ী চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু হয়। ব্যতিক্রমী জীবনের এ মানুষগুলো মুসলমান হলেও মানতা সম্প্রদায় নামে পরিচিত। শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানসহ কোনো মৌলিক চাহিদাই পূরণ হয় না। নেই স্যানিটেশন ব্যবস্থা, পুষ্টিকর খাদ্যের জোগান কিংবা বিশুদ্ধ পানির সুবিধা। নিজস্ব কোনো সম্পত্তি নেই। ভাসমান জীবন। নিজস্ব কোনো ভূমি না থাকায় মৃত্যুর পর স্থানীয়দের কাছ থেকে মাটি কিনে কবর দেয়া হয়। আবার কিছু সময় মৃতদেহ পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়।

ভাসমান জীবনযাপনে এদের স্থায়ীভাবে জন্ম সনদ, এনআইডি বা কোন লিখিত পরিচয় পত্র নেই। এরা যেমন এদের সন্তানেরাও তেমন।

মরিয়াম বেগমের সাথে কথা হলে সে জানায়, তার জন্ম ২৩ বছর আগে এ নৌকাতে। জন্ম হয়েছিল ভোলা বঙ্গেরচর এলাকায়। সেখান থেকে প্রায় ১৬-১৮ বছর হয়েছে মতিরহাট পরবর্তীতে আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরে বসবাস করছে।তার বাবা ছিল জব্বার সর্দ্দার। মুনছুর মাঝি লুৎফুর নাহারের স্বামী। কি করেন জানতে চাইলে হেঁসে উঠে বলেন, নদী মাছ ধরি। মাছ ধরে সবাই মিলে এ নৌকাতে খাই। অন্য কাজের কথা বললে এক কথায় বলেন, করি না। নদীতে মাছ না পেলে কি করেন, উত্তরে বলেন অন্য কাজ পারি না। কোনমতে দিন চলে।

গোলাম হোসেন সর্দ্দার বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। মতিরহাটে কত বছর জানতে চাইলে বলে, প্রায় পনের বছর। ছয় ছেলে দুই মেয়ে। সবাইকে নিয়ে একটি নৌকায় তার সংসার। কিছুদিন বরিশাল মেহেন্দীগঞ্জ ছিলেন।

আ. সালেম, জাহাঙ্গীর, আলীম, লিটন, কবির সবার সাথে কথা হয়। সবাই একই কথা বলে। স্থায়ী কোন বসত বাড়ি নেই। এ নৌকাতে বসবাস করে। নদীতে মাছ ধরে সবাইকে নিয়ে জীবন চালাই। এ মতিরহাটে ১২-১৫ বছর রয়েছি। ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পড়ালেখার কথা বললে জানায়, স্কুলে পড়ে না।পড়ে কি হবে? পড়াতে টাকা লাগে। টাকা নাই। আরো অনেক কথা।

বেলাতুন বিবি ও সোহাগী মাত্র বছর দেড়েক আগে বিয়ে হয়েছে। দু'জনের এটি করে সন্তান আছে। এ নৌকাতে বিয়ে হয়েছে। স্বামীর সাথে সাথে নিজেরাও নদীতে মাছ ধরে।

লেতু মাঝি বিয়ে সম্পর্কে জানতে চাইলে জানান, পূর্ব পুরুষের রীতি অনুযায়ী আমাদের সন্তানদের বিয়ে হয় এক নৌকা থেকে অপর নৌকায় পছন্দের মেয়েটিকে তুলে নিলেই বিয়ে হয়ে যায়। তবে এখন কারো কারো বিয়ে রেজিস্ট্রির মাধ্যমেও হচ্ছে। আবার দাম্পত্য কলহের কারণে যদি ছাড়াছাড়ি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তাহলে ওই বধূটি স্বামীর নৌকা থেকে লাফ দিয়ে বাবার নৌকায় গেলেই তালাক হয়ে যায়। কম বয়সের ছেলে-মেয়ে বিয়ে বেশি হয়। তবে এখন বিয়ে, তালাক সম্পর্কে অনেক সজাগ রয়েছে।

মাছ শিকারের সময় শিশু সন্তানকে নৌকায় দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখে। যাতে পানিতে পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পায়। বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ অন্যতম রীতি। কেউ কেউ একাধিক বিয়েও করেন। এদের স্ত্রীরা খুব পরিশ্রমী হয়। মাছ ধরাতে পারদর্শী নারীদের একাধিক বিয়ে হয়। এরা বেশির ভাগ বরিশাল মেহেন্দীগঞ্জ, বাবুগঞ্জ, পাতার হাট ভোলা, লালমোহন, হুল্লা থানা, বঙ্গচর ভোলার এলাকার ভাসমান বাসিন্দা। মতিরহাট এলাকায় এরা দীর্ঘদিন বসবাস করে। সারাদিন নদীতে মাছ ধরার পর রাতে নৌকাতে জোরে জোরে গান-বাজনা করে সময় কাটায়।

আজন্ম প্রেম নদীর সাথে। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে মাঝে মাঝে ঝড়ো হাওয়া, ঘূর্ণিঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। নদীতে জলদস্যুের কবলেও পড়ে। তারপরও জীবন থেমে নেই। ভাসমান জীবন বয়ে চলে আপন গতিতে। যুগের পর যুগ এদের বসবাস ভাসমান নৌকাতে-ই হয়ে এসেছে। এরা স্থায়ী আবাস্থল গড়ে তোলে বসবাস করবে। সে ধরনের কোন চিন্তা এদের মধ্যে নেই। এরা পূর্ব পুরুষের মতে চলে এসেছে। পরিবর্তন বলতে নৌকা নিয়ে আজ এধারা, কাল ওধারা।

নদীপাড়ে খেলাধুলায় মত্ত শিশুদের স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে রাকিব, সজিব, আঁকিব, রূপবান, শাহীন, খতেজা, দীন ইসলাম, মঙল, বেগম বলেন, আমরা স্কুলে যাই না। স্কুলে আমাগোরে দেয় না। স্কুলে পড়ে কি হবে। আমরা বড় হিলে নদীতে মাছ ধরমু। এসব বলে যাদের সবার বয়স চার থেকে ছয় বছর পর্যন্ত।

স্থানীয় লোকজনেট সাথে কথা বলে জানাযায় ভাসমান গোষ্ঠীর মানুষগুলো স্রোতের বিপরীতে থাকে। এরা মুল ধারায় আসতে চাইনা বিধায় সরকারে সকল প্রকল্পের সুযোগ-সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত।

মোঃ শাহ্ জালাল।।
বুখাইনগর বাজার, চরমোনাই, বরিশাল।
আড়িয়াল খাঁ নদীর তীর থেকে।




আপনার মূল্যবান মতামত দিন: