মোঃ শাহ্ জালাল।।
নির্বাচন আসলেই গ্রামবাসীরা তাদের সমার্থ অনুযায়ী ও হাঁস-মুরগির ডিম বিক্রি করে পাঁচ দশ টাকা করে দান করেন প্রনব কুমার বিশ্বাসকে মেম্বর নির্বাচন করার জন্য। কিন্তু কেন, কে এই প্রনব, কেন বা মানুষ তাকে এতো ভালোবাসে?? যেখানে নির্বাচন করতে কেউ করে লাখ লাখ টাকা ব্যয় সেখানে এমন ঘটনা শুনা মানেই চোখ আকাশে উঠার কথা বা খানিকটা অবাস্তব মনে হতে পারে। কিন্তু না এমন ঘটনা ঘটে আসছে ২০১১ সাল থেকে যশোরের মণিরামপুর উপজেলার ৫ নং হরিদাসকাটি ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডে। ৯ নং ওয়ার্ডটি মূলত কুচলিয়া,নেবুগাতী,দিগংগা গ্রাম নিয়ে গঠিত। এই ওয়ার্ডের ভোটার সংখ্যা ২৫শত প্লাস যার পুরুষ ভোটার ১২শত এবং নারী ভোটার ১৩ শত প্লাস। গত ২৮ নভেম্বর দেশব্যাপী তৃতীয় ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। একই ধাপে মণিরামপুর উপজেলা ব্যাপি ১৬ ইউপিতে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই নির্বাচনে তৃতীয় বারের মতো মেম্বর হলেন প্রনব কুমার বিশ্বাস উপজেলার ৫নং হরিদাসকাটি ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ড থেকে ফুটবল মার্কা নিয়ে। আজ একান্ত সাক্ষাতে কথা হয় প্রনব মেম্বর এর সাথে। প্রশ্ন করা হয় কেন তাকে গ্রামবাসীরা নিজেদের খরচে বার বার মেম্বর হওয়ার সুযোগ দিয়ে থাকেন। জবাবে প্রনব মেম্বর বলেন- কাছে নেই টাকা-পয়সা চলছে ইউপি নির্বাচন গত দুইবার মেম্বার হয়েছি এবার নির্বাচন না করলে মান সম্মানের বিষয়। কি করি কি করি যখন ভেবে দিশেহারা তখন গ্রামবাসী তৃতীয় বারের মতো এবারও আমাকে নির্বাচন করার জন্য পাশে এসে দাঁড়ালেন। আমি প্রথম ২০১১ সালে আমার ওয়ার্ডের কাস্টিং ১৮১১ ভোটের মধ্যে ৭৩৫ ভোট পেয়ে প্রথম মেম্বর নির্বাচিত হয়। সেবার নির্বাচ করি চায়ের দোকানে ইয়ার্কি আড্ডা করতে করতে এক আলোচনার মাধ্যমে। গ্রামবাসীরা গ্রাম থেকে পাঁচ টাকা দশ টাকা চাঁদা তুলে ১৩ হাজার দিয়েছিলেন নির্বাচন করতে। পোস্টার মাইকিং সহ অন্যঅন্য খরচ করার পরেও আমার কাছে নির্বাচনের পর ১৭শত টাকা বেঁচে ছিল সেই টাকা আমি গ্রামের অসহায় পরীক্ষার্থীদেরকে দিয়েছিলাম। দ্বিতীয় বার ২০১৬ সালে ওর্ডের ১৯৩৭ কাস্টিং ভোটের ভিতর ৭৫০ ভোট পেয়ে মেম্বর হয়েছিলাম। সেবার আমার পকেট থেকে ১৩ টাকা খরচ হয়েছিল। বাকি টাকা আমার এলাকার গ্রামবাসীরা বহন করেছিল আমাকে মেম্বর বানানোর কারণ হলো আমি ২০১১ সালে মেম্বর হওয়ার পর থেকে আজ পর্য়ন্ত আমার ওয়ার্ডের কোন বয়স্ক ভাতা, ১০ টাকা চালের কার্ড, বিধবা ভাতা, রাস্তার কাজ, শ্রমের বিনিময়ে কাজ, কোন প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য কখনও কারো থেকে একটা টাকা নেয়নি। বরং নিজ খরচে আমি বাড়ি বাড়ি যেয়ে গ্রামবাসীকে যে কোন কাজের সমাধান করে দিয়ে থাকি। কেউ অসুস্থ হলে হাসপাতালে নিয়ে যায়, কেউ মারা গেলে দ্রুত শেষ কার্য সম্পন্ন করার সহযোগিতা করি। মূল কথা আমি সবসময় ওয়ার্ডের অসহায় মানুষের পাশে থাকি সুখে দুখে বিপদে আপদে। আমাকে গ্রামবাসীরা যে যখন ডাকে আমি সাথে সাথে চলে যাই সহযোগিতা করার জন্য। গ্রামের অসহায় কোনো পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে না পারলে সহযোগিতা করি, প্রতিবছর বই খাতা কলম কিনেদি। শীতের সময় শীতবস্ত্র বিতরণ করার চেষ্টা করি। আপনার জানেন আমরা পানি বন্দি জীবনযাপন করছি দীর্ঘ বছর যাবতকাল। এই বন্ধি জীবনের ভিতর দিয়ের গ্রামবাসীকে সাথে নিয়ে এলাকা থেকে সন্ত্রাস ও মাদক মুক্ত করেছি। আসলে আমি মেম্বারি করি কিন্তু আমি নিজেকে মেম্বার হিসেবে দাবী করি না। মেম্বার হলো তারাই যারা আমাকে ভোট দিয়েছে। আমি মূলত একজন ভালো সেবক তাই আমাকে বারবার মানুষ ভোট দিয়ে মেম্বর তৈরী করে থাকেন। তৃতীয় অর্থাৎ এবার ২৮ নভেম্বর মণিরামপুর উপজেলান ব্যাপী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণার ছড়াছড়ি এর ভিতর শুরু হলো করোনাভাইরাস এর দুই বছর পর এসএসসি পরীক্ষা। নিজ নির্বাচনী এলাকার পরীক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে প্রথম থেকে আমি ওয়ার্ডের ভিতর আমার নির্বাচনী প্রচার মাইকিং বন্ধ রেখেছিলাম। এসএসসি পরীক্ষা শেষে ২৩ নভেম্বর থেকে মাইকিং শুরু করি। এবাররো আমাকে গ্রামবাসী তাদের দানের টাকায় নির্বাচন করার সুযোগ করে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছেন। এবার কিন্তু আমি সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে মেম্বর হয়েছি গত দুই বারের চেয়ে। এবার ২০৩৭ কাস্টিং ভোটের ভিতর ৯৫৭ ভোট পেয়েছি। তবে আরো একটা ভাগ্যের ব্যাপার হলো আমি তিন তিন বার একই প্রতিক ফুটবল পেয়েছি। আমার এ বিজয় অসহায় ও বিবেকবাণ মানুষের বিজয়। এবার আমার প্রাপ্ত ভোট ফুটবল ৯৫৭ । প্রতিদ্বন্দী দুজন প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোট মোরগ ৬২৭ ও আপেল ৪০৪ ভোট । আমার নির্বাচনী ভাষ্য ছিলো আমি হারলে গোটা গরীব অসহায় পরিবার হারবে । সব চেয়ে খুশী হয়ে ছিলাম আমার ওয়ার্ডে কুচলিয়া,নেবুগাতী,দিগংগা গ্রামের কোন গরীব পরিবার প্রতিদ্বন্দী প্রার্থীদের পক্ষ না নেওয়ায়। সকল গরীব অসহায় মানুষের পদতলে রইলো প্রণাম ।নির্বাচনী খরচ সম্পূর্ণ দানের টাকায় । কথা হয় ওর্ডের বয়স্ক ভাতা প্রাপ্ত ৭৫ বছরের বৃদ্ধ গোবিন্দ বিশ্বাস এর সাথে। তিনি বলেন প্রনবকে আমরা মেম্বার বানায় তার কারণ হলো সে কোন ভাতার কার্ড করতে টাকা পয়সা নেয় না। সে সবসময় গ্রামের অসহায় মানুষের পাশে থাকে বিধায় আমরা গ্রামবাসীরা তাকে টাকা পয়সা দান করি নির্বাচন করার জন্য। প্রনব অমার ছেলের মতো সে অত্যন্ত ভালো ছেলে। গ্রামের অল্পবয়সী বিধবা ঋতু রাণী রায় (৩৬) বলেন আমার স্বামী মারা যাওয়ার আমি অসহায় হয়ে পড়ি। মেম্বর জানতে পেরে নিজে থেকেই কোন টাকা পয়সা ছাড়াই আমার বিধবা ভাতার কার্ড করে দিয়েছেন। এই জন্য এবারও আমরা প্রনব দাদাকে ভোট দিয়েছি। এবং আমার হাঁস-মুরগির বিক্রি করে দাদার নির্বাচনী খরচ দিয়েছি। দাদা যেন সারাজীবন আমাদের সুখে দুখে পাশে থাকতে পারেন।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: